মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবির [ মোহাম্মদ সেলিম ] : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবিরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল যুব শিবিরের কর্মকাণ্ড। যুব শিবিরের মাধ্যমেই হাজার হাজার তরুণ-যুবককে গেরিলাযোদ্ধায় পরিণত করা হয়। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, তাই এই যুদ্ধে গেরিলাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রীতিমাফিক যুদ্ধ (কনভেনশনাল যুদ্ধ) করা সম্ভব ছিল না। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার তরুণকে গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধের উপযুক্ত করে তোলা ছিল সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
Table of Contents
যুব শিবির : ধারণা
১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসের দিকে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, গণহত্যার মুখে অগণিত ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, নারী, শিশুসহ সাধারণ জনগণ জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু ছাত্র, যুবক, তরুণদের একটা বড় অংশ ভারতে শুধু আশ্রয় গ্রহণের উদ্দেশ্যে যায়নি। বরং দেশমাতৃকার ডাকে, দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের জন্য তারা ভারতে গমন করে। এই বিরাট যুবশক্তিকে গেরিলাযোদ্ধায় পরিণত করার প্রক্রিয়া হিসেবে ‘যুব শিবির’ ধারণার জন্ম দেন ড. আবু ইউসুফ (ওরফে ড. হাবিবুর রহমান)। নিম্নে যুব শিবিরের ধারণাপত্র সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
ক. আশ্রয় গ্রহণকারী জনসংখ্যার মধ্যে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য ভিন্ন শিবির স্থাপন; খ. প্রথম স্তরে যে-শিবিরে তাদের নেওয়া হবে সেগুলো হবে অভ্যর্থনা শিবির।
গ. প্রশিক্ষণ শেষে বাছাই করে যে যে-রকম উপযুক্ত সেইভাবে নিয়োগ করা হবে। একদল যাবে মূল বাহিনীতে, আরেক দল যাবে নিয়মিত বাহিনীর সাথে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিতে। তাছাড়া অন্যদের জন্যও যোগ্যতা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল।
ঘ. উদ্বুদ্ধকরণ এবং শৃঙ্খলা সম্বন্ধে জ্ঞানদান ও শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব নেবে বাংলাদেশ সরকার।
ঙ. পরবর্তীকালে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহ করার দায়িত্ব থাকবে আমাদের ও ভারত সরকারের উপর যৌথভাবে।
যুব শিবির পরিচালনা :
প্রশাসনিক কাঠামো ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে যুব শিবির কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সরকার সূচনালগ্ন থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে পূর্বাঞ্চলেই প্রথম যুব শিবিরের কার্যক্রম শুরু হয়। কারণ ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর মধ্যে ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক যোগাযোগ তুলনামূলক ভাবে বেশি সুবিধাজনক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ত্রিপুরার রাস্তা-ঘাট, প্রাকৃতিক পরিবেশ যা মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের বিরাট সংখ্যায় এই অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণে আগ্রহী করে তোলে।
১৯৭১ সালের মে-জুন মাসে আগরতলায় ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ও বিএসএফ-এর সহায়তায় ‘খুব অভ্যর্থনা শিবির’ স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের পর যুব শিবির ব্যবস্থাপনার জন্য ‘বোর্ড অব কন্ট্রোল ইয়ূথ ক্যাম্প (Board of Control Youth Camp) গঠন করা হয়। যুব শিবির ব্যবস্থাপনায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। তাঁর অধীনে বোর্ডের কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
বোর্ডের গঠন নিম্নরূপ :
অধ্যাপক ইউসুফ আলী – চেয়ারম্যান
ড. মফিজ চৌধুরী, এমপিএ – সদস্য
ক্যাপ্টেন করিম – সদস্য
শ্রী গৌর চন্দ্র বালা, এমপিএ – সদস্য
সোহরাব হোসেন, এমপিএ – সদস্য
মোহাম্মদ নূরুল কাদের – সচিব
যুব শিবির পরিচালনায় জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যানসহ বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের অনেক দায়িত্ব ছিল। কেন্দ্রের অনুরূপ জোনাল কাউন্সিল পর্যায়ে ‘বোর্ড অব কন্ট্রোল ইয়ূথ ক্যাম্প’ গঠন করা হয়। যুব শিবিরের রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যে কারণে যুব শিবির পরিচালনায় অধিকাংশই ছিলেন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ)। তবে সামরিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও মেজর পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ।
ইয়ুথ কন্ট্রোল বোর্ডের প্রধান দায়িত্ব ছিল যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য যুবকদের নির্বাচন করা। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ.কে. খন্দকারের নির্দেশনা অনুযায়ী যুব শিবিরের পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) এস. আর. মীর্জা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যুব শিবিরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এ. কে. খন্দকারই ঠিক করে দিয়েছিলেন প্রতিটি গেরিলাদলের সদস্যসংখ্যা হবে ১০ জন এবং ১ জন গ্রুপ লিডার থাকবে। ডেপুটি চিফ অব স্টাফের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গেরিলাদলকে অস্ত্র দেওয়া হতো।
বিভিন্ন ক্যাম্পে অর্থ বণ্টন করাও ইয়ুথ কন্ট্রোল বোর্ডের অন্যতম দায়িত্ব ছিল। বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক ইউসুফ আলী নিজে অর্থ বিতরণ করতেন। ক্যাম্প ইন চার্জদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে অর্থ পৌঁছাত। যুব শিবিরে ক্যাম্প ইন চার্জ ছিলেন আওয়ামী লীগের এমএনএ বা এমপিএ অথবা দলের কোনো নেতা।
ন্যূনতম প্রয়োজনের ভিত্তিতে শিবিরে অবস্থানকারী যুবকদের জন্য মাথাপিছু অর্থ বরাদ্দ করা হতো। বরাদ্দকৃত অর্থে কোনো রকমে পোশাক ও খাবারের সংস্থান করা হতো। পোশাকের মধ্যে ছিল লুঙ্গি, শার্ট ও একটা গামছা। মাথায় গামছা বেঁধে চলা ছিল গেরিলার প্রতীক। খাবারের মধ্যে প্রধানত ভাত, আলুভাজি, কুমড়াভাজি আর ডাল। মাঝে মাঝে কেবল ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হতো। মাছের ব্যবস্থা ছিলই না। বিএসএফ মাসে দু’একবার ছাগল এনে দিলে মাংসের ব্যবস্থা হতো। খাবারের মান বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার যুব শিবিরের ছেলেদের প্রত্যেকের জন্য ১ টাকা ২৫ পয়সা বরাদ্দ করেন।
যুব শিবির পরিচালনার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে উইং কমান্ডার (অব.) এস. আর. মীর্জা বলেছেন, “আমার সার্বক্ষণিক কোনো ট্রান্সপোর্ট ছিল না। আমি যুব শিবিরগুলিতে খুব একটা যেতেও পারতাম না। কেউ গেলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতো। আমার ভারতীয় কাউন্টার পার্ট ছিলেন একজন ব্রিগেডিয়ার। নাম ব্রিগেডিয়ার মাস্টার। নানা অসুবিধার মধ্যেও আমি কয়েকবার অবশ্য বিভিন্ন যুব শিবির পরিদর্শন করার সুযোগ পেয়েছি। একবার ব্রিগেডিয়ার মাস্টারের সঙ্গে শিলং পর্যন্ত গিয়েছিলাম। এ সময় ৬ নম্বর এবং ৭ নম্বর সেক্টর এলাকায় গড়ে ওঠা যুব শিবিরগুলি ভালোভাবেই ঘুরে দেখেছিলাম। তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা শুনেছিলাম।
একবার কর্নেল ওসমানী আমাকে ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরে পাঠালেন সেকেন্ড বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সেস অফিসারদের ফাইনাল সিলেকশনের জন্য। আর একবার ব্রিগেডিয়ার মাস্টার আমাকে তুরা নিয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণভাবে আমার কাছে যে সব এমএনএ, এমপিএ বা কোনো রাজনৈতিক নেতা আসতেন তাদের কাছ থেকে ক্যাম্পের খবরাখবর পেতাম। তাদের মাধ্যমে যুব শিবিরে অবস্থানরতদের তালিকাও পেতাম। আমার মূল কাজ ছিল ভারতীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের সাথে সার্বক্ষণিক লিয়াজোঁ রক্ষা করা। বিটুইন বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইন্ডিয়ান রিলিফ অ্যান্ড রিহ্যাভিলেটেশন মিনিস্ট্রি। কর্নেল লুথরা ঐ মিনিস্ট্রির অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
সে সময় পশ্চিমবঙ্গে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ আমাদের যুব শিবিরসমূহকে লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদান করছিল। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ সব যোগান দিতো। ত্রাণ হিসেবে কাপড়-চোপড়, খাদ্য ইত্যাদি বেশি ছিল। এমএনএ এবং এমপিএ-দের মাধ্যমে আমি আমাদের যুব শিবিরগুলির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতাম। এ সব ডিমান্ড এবং বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে খাদ্য, কাপড় চোপড় সম্পর্কে যে সব অভিযোগ আসতো সে বিষয়গুলি সম্পর্কে আমি ঐ ব্রিগেডিয়ার মাস্টারকে জানাতাম। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেন।
ইয়ুথ কন্ট্রোল বোর্ডের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দুটি ইয়ুথ ক্যাম্প অধিদপ্তর (ডাইরেক্টরেট) গঠন করা হয়। পূর্বাঞ্চলের যুব শিবিরের অধিদপ্তর ছিল ত্রিপুরা রাজ্যে। আর পশ্চিমাঞ্চল যুব শিবিরের অধিদপ্তর ছিল পশ্চিমবঙ্গে।
যুব শিবিরের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড সম্পাদনের লক্ষ্যে প্রতিটি ক্যাম্পের জন্য কিছু পদ সৃষ্টি করা হয়।
- ক্যাম্পপ্রধান বা ইন চার্জ (১ জন)
- উপ ক্যাম্পপ্রধান বা ডেপুটি ইন চার্জ (১ জন)
- ক্যাম্প তত্ত্বাবধায়ক (২ জন)
- স্বাস্থ্য অফিসার (২ জন)
- ছাত্র প্রতিনিধি (২ জন)
- পলিটিকাল মটিভেটর (৪ জন)
- ফিজিকাল ইনস্ট্রাক্টর (৪ জন)
পূর্বাঞ্চলে যুব শিবিরের সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পশ্চিমাঞ্চলে সেভাবে বাড়েনি। আহমদ রেজা পশ্চিমাঞ্চলের যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহের পরিচালক ছিলেন। শুরুর দিকে যুব শিবির অধিদপ্তরের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁরা হলেন –
- মাহবুব আলম, প্রকল্প সমন্বয়কারু
- ড. হাবিবুর রহমান, পরিচালক (প্রশিক্ষণ)
- অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, এমএনএ
- জনাব মুজাফফর আহমদ, এমএনএ
- জনাব খালেদ মুহম্মদ আলী, এমএনএ
- জনাব বজলুর রহমান
- অধ্যাপক দেবব্রত দত্তগুপ্ত, উপপরিচালক ও প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী
- জনাব মোশারফ হোসেন, হিসাবরক্ষণ অফিসার
যুব শিবিরের সঙ্গে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সরাসরি যুক্ত ছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ ৭টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ওপর। প্রধানমন্ত্রী নিজে ছিলেন যুব শিবির সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ, -স্বাভাবিক কারণেই মন্ত্রিসভার বিভিন্ন বৈঠকে যুব শিবিরের নানা বিষয় স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ.টি. ইমাম লিখেছেন, “মন্ত্রিসভায় যুব শিবির পরিকল্পনা সম্বন্ধে প্রথম আলোচনা হয় ২২ জুনের (১৯৭১) সভায়। প্রধানমন্ত্রী আলোচনার বিষয়বস্তু সংক্ষেপে স্বহস্তে এইভাবে সিদ্ধান্তটি লিপিবদ্ধ করেন :
৪. যুব শিবির সংস্থা মাত্র একটি মাধ্যমে সমন্বয় করা হবে; ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ এই চেষ্টা করবেন না যাতে সঙ্গতি নষ্ট হয়। পোশাক এবং হেলমেট সমস্যা।
ক. যুব শিবির পরিকল্পনা/ছক অনুমোদন করা হলো।
খ. পরিবর্তিত আকারে যুব শিবির প্রকল্প চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত।
২৯ জুলাই (প্রধানমন্ত্রীর নিজ হাতে লেখা নোট)
সকলেই উপস্থিত। প্রফেসর ইউসুফ আলী বিশেষভাবে আমন্ত্রিত। প্রফেসর ইউসুফ আলী ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং যুব শিবিরের উপর তাঁর প্রতিবেদন উপস্থাপন করলেন।
পরের লাইনে লেখা
১. যুব শিবির বিশেষ সময় (zero hour)
আমার (এইচ. টি. ইমাম) যতদূর মনে পড়ে কয়েকটি শিবির বন্ধ এবং অপর কয়েকটি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, কিন্তু বিস্তারিত লেখা নেই কিছু।
মন্ত্রিসভায় যুব শিবির সংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ৯ আগস্ট তারিখে গৃহীত হয়।
১. যুব শিবির অভ্যর্থনা শিবিরগুলি বাংলাদেশ সরকার দেখাশুনা করবে।
প্রতিরক্ষা সচিব নভেম্বর মাসে মন্ত্রিসভার বিবেচনা ও জরুরি সিদ্ধান্তের জন্য একটি সার-সংক্ষেপ পেশ করেন। বিষয়বস্তু এইরকম :
১. ঐ সময় বিভিন্ন অভ্যর্থনা শিবিরে ১ লক্ষ এবং যুব শিবিরে ২০,০০০ যুবক অপেক্ষমাণ ছিল।
২. ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ১ লক্ষ কম্বল ও ১ লক্ষ জ্যাকেট সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে দেখা যায় প্রয়োজনের তুলনায় একটু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
৩. এই ঘাটতি মিটানোর জন্য আমরা ৫০,০০০ চাদর/হাফ হাতা সোয়েটার কিনতে চাই। খরচ হবে ৫০,০০০×৩০ = ১৫,০০,০০০/= ১৫ লক্ষ রুপি। অতি দ্রুত অর্থবরাদ্দের জন্য অনুরোধ করা হলো। যুব শিবির অধিদপ্তর সত্বর প্রতিটি শিবিরে উল্লেখিত দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করবেন। ”
যুব শিবিরের কাজের সমন্বয়ের জন্য মাঝে মাঝে ইয়ুথ কন্ট্রোল বোর্ড, যুব শিবির ও কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির যৌথসভার আয়োজন করা হতো। ইয়ুথ কন্ট্রোল বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক ইউসুফ আলী যৌথ সভা আহ্বান করতেন এবং ৮ থিয়েটার রোড কার্যালয়ে সভা অনুষ্ঠিত হতো। ইয়ুথ কন্ট্রোল বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ আলী লিখেছেন যে,
“কামারুজ্জামান সাহেব (ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী) এবং আমি প্রায় এই ‘যুব অভ্যর্থনা শিবির’ এবং ‘যুব শিবিরগুলি’ পরিদর্শন করতাম, আমাদের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে একটি হেলিকপ্টার নির্দিষ্ট করা ছিল। চব্বিশ পরগনা জেলার হাসনাবাদ টাকী থেকে শুরু করে পূর্বাঞ্চলের আগরতলা সাবরুম পর্যন্ত সীমান্ত বরাবর দীর্ঘ এলাকাব্যাপী এই সমস্ত শিবির স্থাপিত ছিল। সুতরাং এগুলির পরিদর্শন কাজ খুব সহজসাধ্য ছিল না। “১০
যুব শিবির : নিরাপত্তা নির্দেশনা
যুব শিবিরের নিরাপত্তার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা আমরা জানি। এমন কী মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের একটি অংশ এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। যুব শিবিরের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করার নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন মাহবুব আলম চাষী। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যুব শিবিরের কার্যক্রম থেকে মাহবুব আলম চাষীকে প্রত্যাহার করে নেন। যুব শিবিরের কার্যক্রম সফল করার জন্য নিরাপত্তামূলক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
ক. যুব শিবিরে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ ও প্রশিক্ষণার্থী ব্যতীত কেউ শিবিরে অবস্থান করতে পারবে না।
খ. যুব শিবিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদর্শিত নীতিমালার আলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অন্য কোনো বিষয় এখানে শিক্ষা দেওয়া হবে না।
গ. পূর্বানুমতি ব্যতীত প্রশিক্ষণার্থীরা শিবিরের বাইরে যেতে পারবে না।
ঘ. যুব শিবির ও ফৌজে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য অবশ্যই ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটরের অনুমোদন থাকতে হবে।
ঙ. রণকৌশলগত কারণে প্রশিক্ষণার্থীদের পরিচয় গোপন রাখা হবে। এবং প্রশিক্ষণ শেষে গেরিলাদের যুদ্ধ তৎপরতার বিষয়াদি অতি গোপনীয় বলে বিবেচিত হবে। ১১
যুব শিবির : বিভিন্ন ধাপ
স্বাভাবিক কারণেই শুরুর দিকে যুব শিবিরের কর্মকাণ্ডে কিছুটা অগোছালো অবস্থা ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হলে, একটি নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর অধীনে কয়েকটি ধাপে যুব শিবিরের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রথমে স্থাপন করা হয় অভ্যর্থনা শিবির ( Reception Camp), পরে চালু হয় যুব প্রশিক্ষণ শিবির (Youth Training Camp)। কয়েকটি পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ক্যাম্পে আগত যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য যুব ক্যাম্পের কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও উপযোগী একটি পাঠক্রম প্রণয়ন করা হয়। এ ছাড়া ভিত্তি ফৌজও গড়ে তোলা হয়। ১২
১. অভ্যর্থনা শিবির ( Reception Camp)
১৯৭১ সালে এপ্রিল-মে মাসের দিকে হাজার হাজার যুবক ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে যেতে শুরু করে। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করতে তাঁরা ভারতে যাননি বরং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর আক্রমণ, নির্যাতনের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ভারতে গেছেন, প্রশিক্ষণ আর অস্ত্রলাভের জন্য। তাঁদের যাত্রাপথও ছিল ভীষণ বিপৎসংকুল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দালালদের চোখে পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু। নিরাপত্তার জন্য সাধারণের চলাচলের পথ এড়িয়ে দুর্গম পথে পায়ে হেঁটে, নৌকায় খাল-বিল, বন-জঙ্গল অতিক্রম করে পরিশ্রান্ত, অবসন্ন অবস্থায় কোনো রকমে সীমান্ত পাড়ি দেয়।
নানা কারণে ছাত্র-যুবকদের বিরাট অংশ ত্রিপুরা রাজ্যে গমন করে। এই যুবকদের জন্য অভ্যর্থনা শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীকালে পূর্বাঞ্চলের ন্যায় পশ্চিমাঞ্চলেও অভ্যর্থনা শিবির গড়ে তোলা হয়। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে অভ্যর্থনা শিবির স্থাপন করা হয়। অভ্যর্থনা শিবিরে সাধারণত ৭ দিনের জন্য যুবকদের থাকার ব্যবস্থা করা হতো। এই সময়ে শিবিরে অবস্থানকারী যুবকদের জন্য খাবার, সাধারণ পোশাক ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হতো। এই শিবিরগুলোর ক্যাম্প ইন চার্জের (ক্যাম্পপ্রধান) দায়িত্ব পালন করতেন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) অথবা জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ)।
২. যুব প্রশিক্ষণ শিবির (Youth Training Camp)
অভ্যর্থনা শিবিরে স্বল্পকালীন অবস্থানের পর যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ শিবিরে স্থানান্তর করা হতো। যুব প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ৪৫ দিন। এখানে তিন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
ক. রাজনৈতিক প্রণোদনা (Political Motivation)
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী যুবকদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার লক্ষ্যে এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এক দিকে মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, অন্য দিকে একটি রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অধীনে এই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। সুতরাং প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের পূর্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নেতৃত্ব, বাঙালির আন্দোলন, সংগ্রাম এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। তাই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রতিটি ক্যাম্পে পলিটিকাল মটিভেটর হিসেবে ৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হতো।
খ. উৎপাদন ও উন্নয়নমূলক কাজের প্রশিক্ষণ (Base Work Training)
সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে দেশের যুবশক্তিকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। মূলত বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতিকে ভিত্তি করে স্থানীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন ছিল এই প্রশিক্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্য।
এই প্রসঙ্গে ইয়ুথ ক্যাম্প অধিদপ্তরের উপপরিচালক দেবব্রত দত্তগুপ্ত লিখেছেন যে, “এই স্বাধীনতা সংগ্রাম যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে যাতে বাঙালি একটি জাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্যে নিজস্ব সম্পদ, শক্তি, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, নেতৃত্ব, কর্ম প্রচেষ্টা ও কঠোর শ্রমের দ্বারা… নিজেরাই নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী হয়ে বেঁচে থাকার দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের উপযুক্ত করে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়াও এই ব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
গ. হালকা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ (Light Arms Training )
একজন গেরিলাযোদ্ধাকে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। যে কারণে একজন দক্ষ গেরিলার ৬ মাসের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ৬ সপ্তাহের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্যে নিয়মিত দৈহিক ব্যায়াম (পিটি) ছাড়াও গ্রেনেড নিক্ষেপ, মাইন পৌতা, হালকা অস্ত্র চালনা, রেকি ইত্যাদি শেখানো হতো।
মুক্তিযুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষ গেরিলা/মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গেরিলাদের আশ্রয় দিয়েছে। সাধারণ জনগণের সাহায্য-সহযোগিতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন দেবব্রত দত্তগুপ্ত। তিনি বলেছেন,
“আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা বিভিন্ন কারণে গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধকেই বেছে নিয়েছিলাম। সুতরাং এই যুদ্ধে দেশের জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া জয়লাভ করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভবপর ছিল না। কারণ, জনতা হলো ‘পানি’ এবং গেরিলারা হলো ‘মাছ’। সুতরাং পানি দুষিত হলে যেমন মাছ বেঁচে থাকতে পারে না, তেমনি জনতার সহযোগিতা না পেলেও ‘গেরিলা’ পদ্ধতির জনযুদ্ধ কোনো অবস্থাতেই সাফল্যমণ্ডিত হয় না। “১৪
ভিত্তি ফৌজ
ভিত্তি ফৌজ নিয়ে আলোচনা খুব একটা নজরে পড়ে না। দেবব্রত দত্তগুপ্তের সাক্ষাৎকারে ভিত্তি ফৌজ সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া সম্ভব। এটা সহজবোধ্য যে, গেরিলাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক আদর্শ প্রভাব বিস্তার করে। সবাইকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া বাস্তবে যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি রাজনৈতিক বিবেচনায়ও তা সমর্থিত হয়নি।
যুব প্রশিক্ষণ শিবিরে ৬ সপ্তাহের ট্রেনিং শেষ করা যুবকদের আরও যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করা হতো। নির্বাচিত যুবকদের ভারতের বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রেরণ করা হতো। এই প্রক্রিয়ায় যে বিরাট সংখ্যক যুবকদের সামরিক ট্রেনিং দেওয়া সম্ভব হতো না, তাদেরকে নিয়েই ‘ভিত্তি ফৌজ’ (সামরিক ও অর্থনৈতিক কর্মী) গড়ে তোলা হয়। তারা সহযোদ্ধার দায়িত্ব পালন করবে।
সশস্ত্র গেরিলা যোদ্ধাদের সরাসরি সহায়তা করবে। “এখানে ভিত্তি’ বলতে মাটিকে এবং ‘ফৌজ’ বলতে সামাজিক চেতনা সম্পন্ন এবং উৎপাদন, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও সমাজের সার্বিক কল্যাণের কাজে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের বুঝানো হয়েছে।”১৫ এই প্রক্রিয়ায় ৫০ হাজারের মতো যুবককে ভিত্তি ফৌজ হিসেবে গড়ে তোলা হয়।
ভিত্তি ফৌজের মূলনীতিতে যুদ্ধের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়াদি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সরকার, প্রশাসন নানা প্রসঙ্গ যুক্ত ছিল। মূলনীতির শুরুতে স্লোগান ছিল, “গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়/শেখ মুজিবের অস্ত্র ধর।” ভিত্তি ফৌজের সাফল্য অনেকাংশে স্থানীয় পর্যায়ের সরকার ব্যবস্থার কার্যকারিতার ওপর নির্ভরশীল ছিল।
যে কারণে ভিত্তি ফৌজদের পঞ্চায়েতের অধস্তন করা হয়। প্রতিটি গ্রামে পঞ্চায়েত গঠন করা হবে। গ্রামের জনসংখ্যার অনুপাতে ৫-৭ সদস্য নিয়ে পঞ্চায়েত গঠিত হবে। পঞ্চায়েত নেতা নির্বাচিত হবেন মূলত আদর্শের ভিত্তিতে। আর পঞ্চায়েত নেতার প্রতি ভিত্তি ফৌজের প্রশ্নাতীত আনুগত্য থাকবে।
ভিত্তি ফৌজকে দেশের ভিতরে ও বাহিরে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করার জন্য যে আইডেন্টিটি কার্ড দেয়া হতো, তার একটি নমুনা নিয়ে উল্লেখ করা হলো।
বিপদ আশংকায় নষ্ট কর
বাংলাদেশ ভিত্তি-ফৌজ বাহিনীর নির্দেশ পত্র
এতদ্বারা জানান যাইতেছে যে, নাম ………….বয়স … পিতা …… গ্রাম …… থানা ….. জিলা ……….. কে বাংলাদেশ ভিত্তি ফৌজ বাহিনীর ……….. নং স্বেচ্ছাসেবক কর্মী হিসেবে গ্রহণ করা হইল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অপর নির্দেশ অনুসারে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে স্বাবলম্বী-কর্মশৃঙ্খলার ভিত্তিতে এবং পঞ্চায়েতী শাসনের মাধ্যমে মুক্তিকামী জীবন যাপন (ও) সমাজ শৃঙ্খলার দুর্গ গঠনের প্রশিক্ষণ নির্দেশ এই কর্মীকে দেওয়া হইল।
মোহর
বাংলাদেশ মুক্তি পরিষদের পক্ষ হইতে
স্বাক্ষর …………..
তারিখ
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুব প্রশিক্ষণ শিবিরের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্র-যুব নেতৃবৃন্দ যুব শিবির পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যুব শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেকের নাম জানা সম্ভব হয়নি। তবে যাঁদের নাম পাওয়া গেছে, সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
যুব শিবির পরিচালনায় বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যেসব কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন, তাঁরা হলেন,
বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তা
ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম-১ নং সেক্টর; ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম-১ নং সেক্টর; মেজর আবদুল মতিন–১ নং সেক্টর; মেজর খালেদ মোশাররফ-২ নং সেক্টর; মেজর কে এম সফিউল্লাহ-৩ নং সেক্টর; ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান-৩ নং সেক্টর; মেজর সি.আর, দত্ত-৪ নং সেক্টর। ১৮
ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা
ব্রিগেডিয়ার মাস্টার–সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং সহযোগিতা; ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং-সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং সহযোগিতা; মেজর সুব্রামনিয়াম-সহকারী পরিচালক, সেন্ট্রাল রিলিফ; ক্যাপ্টেন বিভুরঞ্জন চ্যাটার্জী-চড়ইলাম যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; মেজর মিত্র-তত্ত্বাবধায়ক;
ক্যাপ্টেন ডি.পি. ধর-কল্যাণপুর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; ক্যাপ্টেন আর.পি. সিং-গকুল নগর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; ক্যাপ্টেন এস. কে. শৰ্মা-চড়ইলাম যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; ক্যাপ্টেন ডি.এস. মঈনী-বাগাফা যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; ক্যাপ্টেন জি.এস. রাওয়াত—গকুল নগর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; ক্যাপ্টেন নাগ– চোতাখোলা যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ভারত সরকারের বে-সামরিক প্রতিনিধি
ড. শ্রী ত্রিগুণা সেন, শিক্ষামন্ত্রী (ভারত); শ্রী শচীন্দ্রলাল সিং, মুখ্যমন্ত্রী (ত্রিপুরা রাজ্য)। শ্রী কে. পি. দত্ত, পরিচালক, শিক্ষা দপ্তর (ত্রিপুরা রাজ্য); শ্রী মনুভাই বিমানী, বাংলাদেশ এসিস্টেন্স কমিটি (ভারত)। 20
বাংলাদেশের ছাত্র-যুব নেতৃবৃন্দ
আ.স.ম. আবদুর রব সহ-সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন। শেখ ফজলুল হক মনি, তৎকালীন যুব নেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন, যুব ও ছাত্র নেতা; নূরে আলম সিদ্দিকী, যুব ও ছাত্রনেতা সৈয়দ রেজাউর রহমান, ছাত্রনেতা, কুমিল্লা; মাইনুল হুদা, ছাত্রনেতা, কুমিল্লা; শহিদ স্বপন কুমার চৌধুরী, যুব ও ছাত্রনেতা; মোস্তাফিজুর রহমান, ছাত্রনেতা।
যুব শিবিরের অভিজ্ঞতা
উৎস (Source)-এর স্বল্পতার কারণে যুব শিবির সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া দুষ্কর। তবে যুব শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনীতিক, আমলা, শিক্ষাবিদ, যুবনেতা ও সেনা কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার গ্রন্থ, স্মৃতিকথায় নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। যেহেতু তাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী বা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, সুতরাং তাঁদের অভিজ্ঞতার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
এমনি কয়েকজনের অভিজ্ঞতা এখানে উদ্ধৃত করা হলো। ১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম যুব শিবির সম্পর্কে তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, “পাকিস্তান থেকে আমাদের কিছু অফিসার পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পেরেছেন এটা ছিল আমাদের জন্য শুভ সংবাদ।
কিন্তু অন্য কিছু ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তুলছিল। খবর পেলাম যে, আমাদের যুব শিবির থেকে বেশকিছু তরুণ ও যুবক পালিয়ে গেছে। এরা হয়ত যুব শিবিরের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কিংবা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যায় হতাশাগ্রস্ত হয়েই এ কাজ করেছিল। তবে এদের সংখ্যা ছিল খুবই কম এবং এ বিষয়টা নিয়ে আমরা অতটা উদ্বিগ্ন ছিলাম না।
আমরা অনেকেই বুঝতে পারছিলাম যে, যুব শিবিরে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে একধরনের গভীর হতাশা বিরাজ করছে। জুলাই মাসের শেষ দিকে মেজর খালেদ মোশাররফ সহ আমি আগরতলার কাছে একটা খুব শিবির পরিদর্শন করি। সেখানে প্রায় তিন হাজার যুবক দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে ট্রেনিংয়ের অপেক্ষায় ছিল।
শিবিরটির সার্বিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। সেখানে তাদের দুবেলা খাবার কোনো ব্যবস্থা তখনও হয়ে ওঠেনি, এমনকি পানি সরবরাহের কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। এ ধরনের অব্যবস্থা বিরাজ করছিল আরও অনেকগুলো যুব শিবিরে। ট্রেনিং নিতে এসে এমন অব্যবস্থা ও দুর্ভোগের মধ্যে অনির্দিষ্টকাল অনিশ্চিতভাবে অপেক্ষা করতে হলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়াই স্বাভাবিক।
ভারতে ট্রেনিং এবং আশ্রয়ের জন্য আসা তরুণ ও যুবকের সংখ্যা এতই অধিক হয়ে পড়ল যে, যুব শিবিরের সংখ্যা পরের দিকে দ্বিগুণ করা সত্ত্বেও সেখানে সবার থাকার সুব্যবস্থা করা এবং সময়মতো তাদের ট্রেনিংয়ে পাঠানো কিছুতেই সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় এখানে উল্লেখ করতে হয়। যুব শিবিরে আসা প্রায় সবাই যেমন ট্রেনিং নেয়া ও পরে ফিরে গিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যেই বাড়িঘর ছেড়ে এসেছিল, শরণার্থী শিবিরগুলোর ক্ষেত্রে কিছু ঘটনা ছিল একেবারেই উল্টো। শরণার্থী শিবিরগুলোর খুব কম সংখ্যক লোকই যুদ্ধ করতে অথবা ট্রেনিং নিতে আগ্রহ দেখায়। মুক্তিযুদ্ধে প্রায় লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রেনিং দেয়া হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে শরণার্থী শিবির থেকে আসা যোদ্ধা এক শতাংশের বেশি হবে না। ২১
যুব শিবিরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে রুমী তাঁর মাকে (শহিদ জননী জাহানারা ইমাম) বলেন, “গ্রামও না, আধা শহরও না, একেবারে পাহাড়ী জঙ্গলে জায়গা, টিলার ওপরে বেড়ার ঘরে, তাঁবুতে আমরা সবাই থাকি। খাওয়া-দাওয়ার কথা আর জিগ্যেস করো না, ওটার কষ্টই সবচেয়ে বেশি।
ভাত আর ডাল। কখনো লাবড়া, কখনো মাছ। সকালে নাশতা রুটি আর ঘোড়ার ডাল (চোকলা-মোকলা সুদ্ধ এক ধরনের গোটা গোটা ডাল, নর্মাল টাইমে বোধ হয় ঘোড়াকে খাওয়ানো হয়) আর রুটি? কতোদিন সে রুটির মধ্যে সেঁকা পোকা পেয়েছি। …সেঁকা পোকাটা নখে খুঁটে ফেলে দিয়ে রুটি খেয়ে নিতাম।
ওই খাবারও তো সবদিন জুটত না। কতদিন গাছ থেকে কাঁঠাল পেড়ে খেয়ে থেকেছি। মাঠ থেকে তরমুজ, বাঙ্গী, আনারস এসব তুলে খেয়ে থেকেছি।”
যুব শিবিরে আদরের সন্তানের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কষ্টের অভিজ্ঞতা শুনে এক নতুন রুমীকে আবিষ্কার করলেন মা জাহানারা ইমাম। স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “আমি একটা নিশ্বাস চাপলাম। এই রুমী! যে প্লেট বা গ্লাস আমার চোখে ঝকঝকে পরিষ্কার মনে হত, তার মধ্যেও সে এককণা ময়লা আবিষ্কার করে ফেলত। আবার ধোয়াত। তার জন্য গমের আটা দু’বার করে চেলে নিতে হত। ডাল ধুতে হত যে কতবার, তার হিসাব নেই, কারণ রান্না ডালে একটা খোসা দেখলে সেই ডাল আর খাবে না। …যুদ্ধ মানুষকে কি রকম বদলে দেয়। ২২
মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন যে, “বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। লাখ লাখ তরুণ ও যুবক এসে তাতে যোগদান করে। এই যুব শিবিরগুলোকে মুজিবনগর সরকারের অর্থে চালানো হতো। শিবির এলাকা থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করা হতো, কিন্তু সব খরচ ‘ফাইন্যানসিয়াল রুলস’ অনুযায়ী হতো। একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার যে নিয়মে তার টাকা বরাদ্দ ও খরচ করে, আমরা যতদূর সম্ভব, সেই ভাবেই করতাম। ”
পশ্চিমাঞ্চলের যুব শিবিরের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা তেমন একটা দেখা যায় না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে রংপুর থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ শামসুল হক চৌধুরী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের সাহেবগঞ্জ ও আসামের সোনাহাটে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অনুমোদনে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকৃত ভুরঙ্গামারী এবং নাগেশ্বরী থানার বিভিন্ন স্থানে হানাদারদের প্রতি আঘাত হানতে থাকে।
বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক অধিকৃত অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে যুব শিবির খোলার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় এই যুব শিবিরগুলো স্থানীয় ভারতীয় জনগণের আর্থিক সাহায্যপুষ্ট ছিল। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার যুব শিবিরগুলোর আর্থিক দায়িত্ব গ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীদের একটি অংশ ভারতে জনমত গঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধকরণ ও মুজিবনগর সরকারের কাজে সহায়তা করেছেন। শিক্ষকদের কেউ কেউ যুব শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সম্পাদক ড. অজয় রায় এ প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন, শিবির (যুব শিবির) কর্মাধ্যক্ষদের অনুরোধে শিক্ষক সমিতি মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু স্কুল ও কলেজের শিক্ষককে আমরা প্রেরণ করি। নিযুক্ত শিক্ষকগণ নিষ্ঠার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করেন। ২৫
তালিকা-১ : অভ্যর্থনা শিবির এবং যুব প্রশিক্ষণ শিবিরের নাম ও অবস্থান
![মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবির - মোহাম্মদ সেলিম [ Youth camp in the war of liberation - Mohammad Selim ] 3 মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবির, তালিকা ১, অভ্যর্থনা শিবির এবং যুব প্রশিক্ষণ শিবিরের নাম ও অবস্থান ১](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2025/04/মুক্তিযুদ্ধে-যুব-শিবির-তালিকা-১-অভ্যর্থনা-শিবির-এবং-যুব-প্রশিক্ষণ-শিবিরের-নাম-ও-অবস্থান-১-1024x863.jpg)
![মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবির - মোহাম্মদ সেলিম [ Youth camp in the war of liberation - Mohammad Selim ] 4 মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবির, তালিকা ১, অভ্যর্থনা শিবির এবং যুব প্রশিক্ষণ শিবিরের নাম ও অবস্থান ২](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2025/04/মুক্তিযুদ্ধে-যুব-শিবির-তালিকা-১-অভ্যর্থনা-শিবির-এবং-যুব-প্রশিক্ষণ-শিবিরের-নাম-ও-অবস্থান-২-1024x740.jpg)
![মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবির - মোহাম্মদ সেলিম [ Youth camp in the war of liberation - Mohammad Selim ] 5 মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবির, তালিকা ২, যুব প্রশিক্ষণ শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এমপি এবং এমএসএ ১](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2025/04/মুক্তিযুদ্ধে-যুব-শিবির-তালিকা-২-যুব-প্রশিক্ষণ-শিবিরের-দায়িত্বপ্রাপ্ত-এমপি-এবং-এমএসএ-১.jpg)
![মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবির - মোহাম্মদ সেলিম [ Youth camp in the war of liberation - Mohammad Selim ] 6 মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবির, তালিকা ২, যুব প্রশিক্ষণ শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এমপি এবং এমএসএ ২](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2025/04/মুক্তিযুদ্ধে-যুব-শিবির-তালিকা-২-যুব-প্রশিক্ষণ-শিবিরের-দায়িত্বপ্রাপ্ত-এমপি-এবং-এমএসএ-২-1024x632.jpg)
বলার অপেক্ষা রাখে না যুব শিবির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অপরিহার্য
অংশ। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে যুব শিবিরের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। যুব শিবিরই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আঁতুড়ঘর। কেবল শারীরিক বা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নয়, অভ্যর্থনা শিবির ও যুব প্রশিক্ষণ শিবির গেরিলা যোদ্ধা ও মুক্তিফৌজের রাজনৈতিক চেতনা ও মনোজগত গঠনে তাৎপর্যময় ভূমিকা পালন করেছে। যুব শিবিরের মাধ্যমেই গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হাজার হাজার যুবক-তরুণদের সংগঠিত করা সম্ভব হয়েছে। অত্যন্ত সুচিন্তিত প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে বিভিন্ন ধাপে যুবকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।
মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে যুব শিবিরের কর্মকাণ্ডের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন সচিব মোহাম্মদ নুরুল কাদের। যুব শিবিরের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,
“যুব শিবির পরিচালনা ছিল সরকারের যুদ্ধকালীন সুদূরপ্রসারী নীতির অন্যতম। এটি ছিল তৃণমূল পর্যায়ে সশস্ত্র যুদ্ধকে শক্তিশালী করার একটি প্রধান উপায়। কারণ এই কার্যক্রম এমন একটা ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, সশস্ত্র যোদ্ধা তৈরি করা, পাশাপাশি উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া, বেসামরিক সরকার পরিচালনা তথা দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ মানুষ এবং প্রায় এক কোটি শরণার্থীর সকল সমস্যার সমাধানের একটি পথ নির্দেশিকা ছিল এখানে।” ২৬
অর্থ, অস্ত্রের অভাব তো ছিলই কিন্তু বড় ভয় ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার। সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, “পাকিস্তানি গুপ্তচরেরা শরণার্থী-শিবির ও যুব শিবির এবং ভারতের অন্যান্য স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেয়ার চেষ্টাও চালায়।… ভারতের মাটিতে এ ধরনের দাঙ্গা শুরু হয়ে গেলে আমরা চরম বিপাকে পড়তাম। ২৭
এত সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অতুলনীয় ত্যাগ আর কষ্ট স্বীকার করেছে প্রশিক্ষণ শিবিরের তরুণ-যুবক সবাই। হাতিমারা শিবিরের কথা লিখেছেন যুব শিবিরের পলিটিকাল মটিভেটর সাঈদ-উর-রহমান। “রাইফেল, স্টেনগান ও গ্রেনেড ছোঁড়া সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দেয়া ও শরীরকে কষ্ট সহিষ্ণু করে সামরিক শিক্ষার জন্যে উপযোগী করে তোলাই এ সবের লক্ষ্য। ছেলেরা সর্ববিধ কাজ নিজেরা করে।
… কঠোর পরিশ্রমের সাথে সাথে খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রামের ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোরতা পালন করা হয়। সকাল বেলায় নাশতা একটা আটার রুটি সাথে কোনো দিন সবুজ চা, বা অল্প ভাজি। দুপুরে বা সন্ধ্যায় এক বাসন ভাত, সাথে সামান্য ডাল বা তরকারী। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মাসান্তে অর্ধেক ডিম বা দু-এক টুকরা মাংস বা মাছ পাওয়া যায়।”২৮
অনেক যুব শিবিরের অবস্থা ছিল বেশ শোচনীয়, এমন কী পর্যাপ্ত পরিষ্কার পানি ও খাদ্যের সংস্থান ছিল না। ১০-১২ বছর বয়সের শিশুরা গ্রেনেড প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তারাও যুদ্ধে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসা করে বলেন,
“We hail the brave young men and boys of the Mukti Bahini for their valour and dedication.”
বাস্তবে থাকা-খাওয়ার কষ্টের বিষয় যুবকরা তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। কারণ দেশকে শত্রুমুক্ত করতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই ছিল জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাঁদের জীবনের বিনিময়ে মাতৃভূমির মলিনতা মুছে দিতে চেয়েছেন।
যুব ক্যাম্পের সংখ্যা নিয়েও বিভ্রান্তি কম নয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র গ্রন্থে যুব ক্যাম্পের সংখ্যা ৫৯টি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধা এএসএম সামছুল আরেফিন লিখেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণদানের জন্য ৫৪টি যুব প্রশিক্ষণ শিবির এবং ৩২টি উচ্চতর প্রশিক্ষণকেন্দ্র গঠিত হয়।
“বোর্ড অব কন্ট্রোল ইয়ুথ ক্যাম্প”-এর সচিব ভিন্নমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয় এই রাজ্যগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী যুব ক্যাম্পের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে ১০৬টিতে উন্নীত হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে অবকাঠামোগত সুবিধা অনুযায়ী ৫০০ থেকে ২৫০০ যুবককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যুব শিবির থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে হাজার হাজার গেরিলা/মুক্তিযোদ্ধা জীবনবাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। অনেকে শহিদ হয়েছেন। তাঁদের অতুলনীয় দেশপ্রেম, ত্যাগ আর কষ্টের ফসল স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
তথ্যনির্দেশ :
১. এইচ.টি. ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, “যুব শিবির সম্পর্কে প্রথম চিন্তা-ভাবনা করেন ড. আবু ইউসুফ (ওরফে ড. হাবিবুর রহমান) মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে, আগরতলায়। তাঁর ধ্যান-ধারণা (concept) ছিল সহজ-সরল, কিন্তু তা ছিল যুক্তিপূর্ণ।” বাংলা একাডেমী, ২০১২, পৃ. ১৭৮ কিন্তু অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্পষ্টভাবে লিখেছেন, “যুব শিবিরের মূল উদ্ভাবক ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা ১৯৮৫, পৃ. ৩৫১
২. এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৮
৩. অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, সাক্ষাৎকার, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, বাংলাদেশের যুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮৫, পৃ. ৩৫১
8. এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১
৫. উইং কমান্ডার (অব.) এস. আর. মীর্জা, সাক্ষাৎকার, সুকুমার বিশ্বাস, সম্পাদক মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুরে অংশগ্রহণকারী প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৪, পৃ. ৬৯
৬. প্রাগুক্ত, ঐ, পৃ. ৬৪
৭. দেবব্রত দত্তগুপ্ত, সাক্ষাৎকার, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৮
৮. প্রাগুক্ত, ঐ
৯. এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮০, ১৮৩
১০. অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫১
১১. মোহাম্মদ নুরুল কাদের, একাত্তর আমার, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ, ২০১২, পৃ. ৮৪-৮৫
১২. দেবব্রত দত্তগুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০০
১৩. প্রাগুক, ঐ, পৃ. ২৯৯
১৪. প্রাগুক্ত, ঐ, পৃ. ৩০০
১৫. প্রাগুক্ত, ঐ, পৃ. ৩০১
১৬. মোহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩-৮৪
১৭. হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০১
১৮. প্রাগুক্ত, ঐ, পৃ. ৩০৫
১৯. প্রাগুক্ত, ঐ, পৃ. ৩০৪-৩০৫
২০. প্রাগুক্ত, ঐ, পৃ. ৩০৫
২১. রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, অনন্যা, ঢাকা, ২০১০, পৃ. ২৩৬-২৩৭
২২. জাহানারা ইমাম, একাত্তরের দিনগুলি, সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা ২০১৩, পৃ. ১৫০-১৫১
২৩. খন্দকার আসাদুজ্জামান, সাক্ষাৎকার, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮৫, পৃ. ২৮৪
২৪. মোহাম্মদ শামসুল হক চৌধুরী, সাক্ষাৎকার, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: পঞ্চদশ খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮৫, পৃ. ৩৫৯
২৫. ড. অজয় রায়, সাক্ষাৎকার, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮৫, পৃ. ৪৭৭-৪৭৮
২৬. মোহাম্মদ নূরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৫
২৭. রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৪
২৮. সাঈদ-উর-রহমান, সাক্ষাৎকার, হাসান হাফিজুর রহমান, সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২৫
২৯. Gary J. Bass, The Blood Telegram, Random House India, 2013. p. 182.
৩০. এ এস এম সামছুল আরেফিন, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনী ও গেরিলা বাহিনী গঠন, দ্রষ্টব্য, অধ্যাপক অজয় রায় ও শামসুজ্জামান খান, সম্পাদক, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস চতুর্থ খণ্ড (প্রথম পর্ব), বাংলা একাডেমী ২০১২, পৃ. ২৬৫ ৩১. মোহাম্মদ নূরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০
আরও পড়ুন: