বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা

বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা : মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে অগ্রসর করিয়া লওয়ার যে আহ্বান ও নির্দেশ দিয়াছেন, তাহাকে অবলম্বন করিয়া বাংলাদেশের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত), কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন শিকদারের নেতৃত্বে), শ্রমিক-কৃষক কর্মী সংঘ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার), পূর্ব বাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন (পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন) এবং পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি রাজনৈতিক ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনে মিলিত হইয়া ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠন করিয়াছেন এবং সর্বসম্মতভাবে নিম্নোক্ত ঘোষণা প্রণয়ন করিয়া বাংলাদেশের জনগণের নিকট উপস্থাপিত করিতেছেন।

বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা

বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনা:

সারা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জীবনে আজ এক চরম মুহূর্ত উপস্থিত। পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট জঙ্গীশাহীর হানাদারবাহিনী ট্যাংক, বোমারু বিমান, মেশিনগান, মর্টার, রকেট, গানবোট প্রভৃতি অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া নিরস্ত্র, নিরীহ, শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশের জনগণের উপর সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় শুরু করিয়াছে এমন এক বর্বর হামলা, সভ্য দুনিয়ার ইতিহাসে যাহার তুলনা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ, শিশু, যুবা, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সমগ্র সাড়ে সাত কোটি জনতাই এই হানাদার দস্যুদের বর্বর নির্যাতনের শিকারে পরিণত হইয়াছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা, মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলির সভা- বৈঠক করছেন - মণি সিংহ, মওলানা ভাষানী, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখসাদা
মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলির সভা- বৈঠক করছেন – মণি সিংহ, মওলানা ভাষানী, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখসাদা

 

বাংলাদেশের এমন কোনো শহর, গ্রাম বা অঞ্চল নাই যেখানে এই পরদেশ লুণ্ঠনকারী দস্যুর দল নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধনসম্পত্তি বিনষ্ট, লুটতরাজ ও নারী নির্যাতন করে নাই। পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট জঙ্গীশাহীর এই হামলা অত্যন্ত আকস্মিক ও বর্বর। দীর্ঘ চব্বিশ বছর গোটা বাঙালী জাতি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক হইতে চরমভাবে নিপীড়িত হইবার পর এইবারই সর্ব প্রথম জাতীয় মুক্তির আশার আলো দেখিতে শুরু করিয়াছিল। জাতীয় মুক্তির এই সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়াই বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী তথা সমগ্র জনতা ইতিপূর্বে বারবার রক্তঝরা সংগ্রামের পথে অগ্রসর হইয়াছিল।

“এই জনতাই মুক্তির দুর্বার আকাঙ্ক্ষা নিয়া হাজার হাজার বীরসন্তানের রক্তের বিনিময়ে সৃষ্টি করিয়াছিল ১৯৬৮-৬৯ সালের গৌরবোজ্জ্বল সুমহান গণঅভ্যুত্থান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলার জনগণ আবার সেই জাতীয় মুক্তির কামনাকেই বুকে করিয়া একচেটিয়া ভাবে আওয়ামী লীগকে ভোটদান করিয়াছিল। তাহারা আশা করিয়াছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে দীর্ঘ চব্বিশ বছরের নিপীড়ন ও নির্যাতনের অবসান ঘটিবে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে নিরস্ত্র অপ্রস্তুত জনতার উপর নামিয়া আসিল শাসকগোষ্ঠীর সশস্ত্র হামলা।

তবে এই হামলা জনগণের আকাঙ্ক্ষা অবদমিত করিতে পারে নাই, বরং শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণাকে আরও বেশি করিয়া তীব্র করিয়া তুলিয়াছে। তাই অপ্রস্তুত অবস্থায় হইলেও জনগণ প্রতিরোধসংগ্রাম শুরু করিয়াছে। যে যেই ভাবেই পারিয়াছে সশস্ত্র আক্রমণের

পাল্টা আক্রমণ করিয়াছে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও বাংলার অসংখ্য তরুণ হানাদারদের বিরুদ্ধে শুরু করিয়াছে সশস্ত্র অভিযান। বাংলাদেশের জনগণ আজ নির্মম অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া এই শিক্ষা লাভ করিয়াছে যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে আপোসের পথে বাংলার মুক্তি আসিবে না। বাংলার জনগণকে বাঁচিয়া থাকিবার তাগিদেই আজ হানাদার দস্যুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রাখিতে হইবে।

বিএসএফ গেস্ট হাউস, গড়িয়াহাট রোড, কলকাতা - উপদেষ্টা কমিটির সভাকেন্দ্র
বিএসএফ গেস্ট হাউস, গড়িয়াহাট রোড, কলকাতা – উপদেষ্টা কমিটির সভাকেন্দ্র

 

জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়ার আহ্বান:

বাংলাদেশের এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, বাংলার সমগ্র জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের পথে অগ্রসর হইতে হইবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ, গণসংগঠন ও শ্রেণি-সংগঠন এবং প্রতিটি নাগরিকের মহান কর্তব্য–পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা রক্ষা করিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের সুমহান ব্রত নিয়া এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। কেননা এ যুদ্ধ সমগ্র জাতির যুদ্ধ, সমগ্র জনগণের যুদ্ধ। সমগ্র জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হানাদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নহে।

এই বাস্তব উপলব্ধির ভিত্তিতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যে আহ্বান ও নির্দেশ দিয়াছেন, তাহাকে অবলম্বন করিয়া ১ জুন বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, ব্যক্তি, গণ-সংগঠন ও শ্রেণি-সংগঠন একত্রিত হইয়া ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করিয়াছে। এই সমন্বয় কমিটির আশু লক্ষ্য হইলো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সরকারের ও মুক্তিসংগ্রামরত সকল শক্তির সহিত সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লওয়া।

আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সফল করিয়া তুলিবার জন্য প্রয়োজন সকল দল মত ব্যক্তির সমবায়ে গঠিত একটি সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের। তাই এই সমন্বয় কমিটির তরফ হইতে আমরা আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাকামী অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, গণ-সংগঠন, শ্রেণি-সংগঠন ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের নিকট এইরূপ একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানাইতেছি।

রংপুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু
রংপুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু

 

কমিটির চূড়ান্ত লক্ষ্য:

এ সমন্বয় কমিটির চূড়ান্ত লক্ষ্য হইল বাংলাদেশকে হানাদার দস্যুদের হাত হইতে মুক্ত করিয়া বাংলার বুকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবিরোধী একটি স্বাধীন, সুখী-সুন্দর গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ইহা হইবে এমনই একটি সমাজব্যবস্থা যেখানে যুগ যুগ ধরিয়া শোষিত কৃষক জোতদারী-মহাজনী শোষণের নাগপাশ হইতে সত্যিকারের মুক্তিলাভ করিবে, যেখানে জমির উপর তাহার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হইবে, যেখানে শ্রমিক পাইবে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পরিবারসহ মানুষের মতো বাঁচিবার গ্যারান্টি, যেখানে বেকারত্বের অভিশাপ থাকিবে না, যেখানে ছাত্রের জন্য থাকিবে বিজ্ঞানভিত্তিক সর্বজনীন গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে বুদ্ধিজীবীর জন্য থাকিবে সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের সুযোগ।

প্রতিটি নাগরিকের জন্য থাকিবে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। এই সমাজ নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করিবে। উন্নত মানের কৃষিব্যবস্থা ও শিল্প বিকাশের মাধ্যমে গড়িয়া তুলিবে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি ও একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। এক কথায় এই সমাজব্যবস্থায় সমগ্র জনগণের জন্য থাকিবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতির ন্যূনতম গ্যারান্টি। এই বাংলা হইবে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী মানুষ, মধ্যবিত্ত, দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণির বাংলা, জনতার বাংলা।

 

একাত্তরে প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন তাজউদ্দীন আহমদ
একাত্তরে প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন তাজউদ্দীন আহমদ

 

কমিটির আশু করণীয়:

উপর্যুক্ত লক্ষ্য অর্জন করিবার জন্য পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে প্রতিহত ও সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করিবার কর্মসূচি হইতেছে সমন্বয় কমিটির আশু কর্তব্য। আমাদের এই কর্তব্য মহান ও কঠিন। যেহেতু হানাদারবাহিনী সামরিক দিক দিয়া শক্তিশালী, অন্যদিকে যেহেতু জনগণের হাতে অস্ত্র নাই সেহেতু এই সমন্বয় কমিটি মনে করে যে, গেরিলাযুদ্ধের কায়দায় ক্রমান্বয়ে শত্রুকে দুর্বল করিয়া এবং নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করিয়া দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়াই অগ্রসর হইতে হইবে।

অন্যদিকে যেহেতু হানাদারবাহিনী বিদেশি, বর্বর এবং সাড়ে সাত কোটি জনতার তুলনায় তাহাদের লোকবল অত্যন্ত নগণ্য, সেই হেতু এই যুদ্ধে জনগণের জয় যে সুনিশ্চিত সে সম্পর্কেও এ সমন্বয় কমিটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এ সমন্বয় কমিটি আরও মনে করে যে, সমগ্র জনগণের শক্তি পূর্ণ ব্যবহারের উপরই যুদ্ধের সাফল্য নির্ভর করে। কোনো বিদেশি শক্তির উপর নির্ভর করিয়া নহে, নিজেদের শক্তিতে বলীয়ান হইয়াই এই মুক্তিযুদ্ধ চালাইয়া যাইতে হইবে।

জনতার মধ্য হইতে সশস্ত্র গণফৌজ গড়িয়া তুলিবার লক্ষ্যকে সম্মুখে রাখিয়া আমাদের গেরিলাযুদ্ধের সূচনা করিতে হইবে। জনতার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষকরাই হইবে গণফৌজের মূল শক্তি। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল হইবে সশস্ত্র গেরিলাযুদ্ধের ঘাঁটি। এ গেরিলাযুদ্ধ পরিচালিত হইবে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সহিত যোগাযোগ রক্ষা ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে। তাই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এই পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি জনগণের নিকট নিম্নলিখিত করণীয় কর্তব্য উপস্থিত করিতেছে:

১. বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে জনতার বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি সমবায়ে সর্বদলীয় গণ-মুক্তি পরিষদ গঠন করিতে হইবে। এ গণ-মুক্তি পরিষদ গ্রামে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সর্ববিধ কর্তৃত্ব গ্রহণ করিবে, গ্রাম-রক্ষীবাহিনী গঠন ও পরিচালনা করিবে এবং গণ-আদালত গঠন করিয়া বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করিবে।

২. পাক-জঙ্গীশাহী সরকারকে দেয়া খাজনা, ট্যাক্স, ঋণ ও সুদ পরিশোধ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখিতে হইবে।

৩. যাহারা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় প্রয়োজনাতিরিক্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখিবে গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ তাহাদের সেই উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য বাজেয়াপ্ত করিয়া জনসাধারণের

মধ্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করিবে।

৪. গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ গ্রামে গরিব জনসাধারণের উপর নিপীড়নমূলক মহাজনি ব্যবস্থা বন্ধ করিবে।

৫.

(ক) যাহারা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সহিত কোনো প্রকার সহযোগিতা সাহায্য প্রদান করিবে অথবা চর হিসাবে কাজ করিবে গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ তাহাদের কঠোরতম শাস্তি প্রদান করিবে এবং তাহাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া গরিব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করিবে।

(খ) যে সকল জোতদার জাতীয় মুক্তির স্বপক্ষে থাকিবে তাহাদের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে যাহাতে গরিব কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের উপর জোতদারের পূর্বতন শোষণ লাঘব হয়।

৬. বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক বাস্তুহারা হইয়া দেশত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছে গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ তাহাদের যাবতীয় সম্পত্তি তত্ত্বাবধান করিবে।

৭. যথোপযুক্ত বিলিবণ্টন, উৎপাদন বৃদ্ধি, কেনা-বেচা, কুটির শিল্পের বিকাশ সাধন প্রভৃতির মাধ্যমে গ্রাম এলাকায় আত্মনির্ভরশীল স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়িয়া তুলিতে হইবে। এই ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হইবে পারস্পরিক সাহায্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা (mutual aid and mutual cooperation)।

৮. শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে জাতীয় ভাবধারা সৃষ্টি করিতে হইবে। প্রচলিত শিক্ষা ও কলুষিত সাংস্কৃতিক রীতিনীতি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করিতে হইবে।

৯.

(ক) গ্রামে গ্রামে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও অন্যান্য জঙ্গী তরুণদের সমবায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গেরিলা দল গঠন করিতে হইবে। এই গেরিলা দল সুযোগ ও সুবিধামতো বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত শত্রুকে খতম ও ক্ষতিসাধন করিবে এবং শত্রুর অস্ত্র কাড়িয়া নিয়া নিজেদের অস্ত্রবল বৃদ্ধি করিবে।

(খ) হানাদারবাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে যাহাতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা, অস্ত্রশস্ত্র, রসদপত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ করিতে না পারে এবং নির্বিবাদে শাসন ও শোষণ চালাইতে না পারে, তাহার জন্য সকল প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সরবরাহ লাইন ইত্যাদির ক্ষতিসাধন করিতে হইবে।

(গ) গেরিলাদের জনগণের আস্থা ও ভালবাসা অর্জনের জন্য

-জনগণকে শ্রদ্ধা করিতে হইবে।

-জনগণকে সাহায্য করিতে হইবে।

-জনগণকে রক্ষা করিতে হইবে।

(ঘ) গেরিলা দল সামরিক দায়িত্ব সম্পাদনের সাথে সাথে জনগণের মধ্যে জাতীয় মুক্তির স্বপক্ষে রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলনও চালাইবে।

(ঙ) যে সকল ব্যক্তি হানাদার পাক সরকার ও পাকবাহিনী অথবা তাহাদের এজেন্টদের সহিত স্বেচ্ছায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক অথবা যে কোনো প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা করিবে তাহারা জাতীয় শত্রু বলিয়া পরিগণিত হইবে। পূর্ণ তদন্ত করিয়া সমষ্টিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তাহাদের খতম অথবা যে কোনো প্রকার শাস্তি প্রদান করা হইবে।

১০. যাহারা জনগণের মনোবল নষ্ট করিবার জন্য গোপনে বা প্রকাশ্যে কোনো প্রকার প্রচারকার্য চালাইবে তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।

১১. যাহারা জনগণের দুরবস্থার সুযোগে ডাকাতি, গুন্ডামি ও অন্যান্য সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত, গণ-মুক্তি পরিষদের মাধ্যমে তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।

১২. যাহারা মুক্তিসংগ্রামকে বিভক্ত ও বিপর্যস্ত করিবার জন্য কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িক ক্রিয়াকলাপ, উস্কানি অথবা প্রচারণা করিবে তাহাদের কঠোরতম শাস্তি প্রদান করা হইবে।

১৩. শহরাঞ্চলে শত্রুকে বিপর্যন্ত ও ব্যস্ত রাখিবার জন্য ‘আঘাত করো ও সরে পড়ো নীতির ভিত্তিতে গেরিলা তৎপরতা চালাইতে হইবে। ১৪. সর্বস্তরের জনগণকে জঙ্গীশাহীর প্রশাসনিক ও সকল প্রকার ব্যবস্থার সহিত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিয়া চলিতে হইবে।

১৫. বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণির প্রতি তাহাদের পূর্ব ঐতিহ্য অনুসরণ করিয়া শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির অচলাবস্থা অব্যাহত রাখিবার উদাত্ত আহ্বান সমন্বয় কমিটি জানাইতেছে।

এই সমন্বয় কমিটি ইহার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সংগঠনের কর্মীদের প্রতি এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব জনগণের সহিত থাকিয়া সুচারুরূপে সম্পন্ন করিবার নির্দেশ প্রদান করিতেছে। এই সমন্বয় কমিটির বহির্ভূত যাহারা অনুরূপভাবে বাংলার মুক্তিসংগ্রামে কাজ করিয়া যাইতেছে বা ভবিষ্যতে করিবে তাহাদের সহিত পরিপূর্ণ সহযোগিতার ভিত্তিতে উপরোক্ত দায়িত্ব পালন করিয়া যাইতে হইবে।

 

পাবনার ঐতিহাসিক শানির দিয়াড়ে মুক্তিযুদ্ধ
পাবনার ঐতিহাসিক শানির দিয়াড়ে মুক্তিযুদ্ধ

 

আমাদের ঘোষণা:

এই পরিস্থিতিতে আজিকার এই জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ও জনগণের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ রাখিয়া ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশের এবং পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষের নিকট দৃঢ়তার সহিত নিম্নোক্ত ঘোষণা পেশ করিতেছে:

– সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর সেবাদাস পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট জঙ্গী শাসকচক্রের হানাদারবাহিনী গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, নারীধর্ষণ ও ব্যাপকভাবে নাগরিক বিতাড়নের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করিবার যে সুপরিকল্পিত অভিযান চালাইতেছে তাহা প্রতিরোধ ও প্রতিহত করিয়া ‘স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করিবার দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করিতেছে।

– এই সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশে যে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম চলিতেছে তাহাকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লইয়া যাইবার জন্য বলিষ্ঠ শপথ গ্রহণ করিতেছে এবং যাহারা অসীম সাহসিকতার সহিত আত্মত্যাগের মধ্য দিয়া এই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করিতেছেন তাহাদের সহিত একাত্মতা ঘোষণা করিতেছে ও তাহাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছে।

– সমন্বয় কমিটি সকল প্রকার দেশি-বিদেশি আপোসমূলক চক্রান্তকে প্রতিহত করিবার শপথ গ্রহণ করিতেছে এবং সুস্পষ্ট ঘোষণা করিতেছে যে, বাংলাদেশের মাটি হইতে হানাদার বাহিনী নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম থামিবে না। প্রতি ইঞ্চি জমির জন্য এবং প্রকৃত জাতীয় মুক্তির জন্য বাংলাদেশের জনগণ রক্ত দিয়াছে, দিতেছে ও ভবিষ্যতেও দিবে।

– বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে যাহারা শহীদ হইয়াছেন, যাহারা লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হইয়াছেন, সর্বস্ব হারাইয়াছেন, এই সমন্বয় কমিটি তাহাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনা প্রকাশ করিতেছে। যাহারা চরমভাবে নির্যাতিত হইয়া শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগে বাধ্য হইয়াছেন, এই সংস্থা মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে তাহাদের নিরাপদ পুনর্বাসনের জন্য সংগ্রামের সংকল্প ঘোষণা করিতেছে।

– বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুবক, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মোজাহিদ এবং সকল স্বেচ্ছা-সৈনিকরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হইয়া স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে যে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করিতেছেন, এই সমন্বয় কমিটি তাহাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছে।

– বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতি এবং বাস্তুহারা শরণার্থীদের প্রতি ভারতীয় জনগণ বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের জনগণ যে সাহায্য ও সহযোগিতা করিয়াছেন তাহার জন্য এই সমন্বয় কমিটি তাহাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছে। এই সমন্বয় কমিটি সিন্ধি, বালুচ, পাঠান, পাঞ্জাবি জনগণ বিশেষ করিয়া শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি জনগণের নিকট পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট জঙ্গী শাসকচক্রের বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের স্বপক্ষে তীব্র গণআন্দোলন গড়িয়া তুলিবার আহ্বান জানাইতেছে।

– এই সমন্বয় কমিটি বিশ্বের সকল স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিকট বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সর্বতোভাবে সাহায্য করিবার আবেদন জানাইতেছে। অফুরন্ত জনবল আমাদের রহিয়াছে, প্রয়োজন অস্ত্র, অর্থ, রসদ, ঔষধপত্র ও নৈতিক সমর্থন।

– এই সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিসংগ্রামরত সকল শক্তির সহিত সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লইবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছে।

– এই সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণি সংগঠন ও গণ-সংগঠন এবং ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল দেশপ্রেমিক জনগণকে ‘জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট’ গঠন করিয়া গণ-যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা ও বাংলাদেশের মাটি হইতে উৎখাত করিবার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাইতেছে। এই সংস্থা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, যেহেতু জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমগ্র জনতার লড়াই, সেই জন্য সমগ্র জনতার আশা আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক একটি সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টই তাহাকে নিশ্চিতভাবে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে অগ্রসর করিয়া লইয়া যাইতে পারে।

 

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম
বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম

 

বাংলার সংগ্রামী জনতা!

সারা বাংলাদেশব্যাপী মরণপণ যুদ্ধ চলিতেছে— স্বাধীনতার যুদ্ধ। লাঞ্ছিত জাতির অপমান মোচনের, পরাধীন দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের এই জীবন-মরণ লড়াইয়ে আমরা সকলেই শরিক হইয়াছি। বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধের ক্ষান্তি নাই, শ্রান্তি নাই। যে দস্যুর দল আমাদের পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নী, পুত্র-কন্যাকে হত্যা করিয়াছে, মা-বোনের সম্ভ্রম বিনষ্ট করিয়াছে, আসুন, আমরা তীব্র প্রতিহিংসার জ্বালা ও ঘৃণা নিয়া সেই দস্যুর উপর সশস্ত্রভাবে ঝাঁপাইয়া পড়ি। তাহাকে খতম করি। রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ করি। আমাদের যুদ্ধ ন্যায়ের যুদ্ধ। তাই জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তানি হানাদার দস্যুর পরাজয় অনিবার্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।

-স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ

– জনতার সশস্ত্র বিপ্লব জিন্দাবাদ

বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি

১ জুন, ১৯৭১

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment