বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাশক্তির ভূমিকা রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। ১৯৭১ সালে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছিল একটু অন্যরকম। বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন বিভাজন প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া এ ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের ওপরেও প্রভাব ফেলে। দুই পরাশক্তির একটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানায়। অন্যদিকে পরাশক্তির অন্য অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। সে সময় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বহু রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সমর্থন জানায় কিন্তু সমাজতান্ত্রিক চীন বিরোধিতা করে এ রাষ্ট্রের।
Table of Contents
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাশক্তির ভূমিকা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের রিপোর্ট বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে চলে আসে। কিন্তু এ কথা স্পষ্ট এবং পরিষ্কার যে, যেসব রাষ্ট্র এবং পরাশক্তি শাসকগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব হিসাব-নিকাশ এবং স্বার্থ বুঝেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য বিটলস খ্যাত জর্জ হ্যারিসন এবং পণ্ডিত রবি শংকর আয়োজন করেছিলেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। জ্যা পল সাত্রসহ বহু বুদ্ধিজীবী দার্শনিক বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন ।
ভারতে সে সময় প্রায় ১ কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করেছিল তৎকালীন ভারত। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে দুবার ভেটো প্রয়োগ ছাড়াও মার্কিন ও চীনা হুমকি মোকাবিলায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ দিকে প্রায় ৫ হাজার ভারতীয় যোদ্ধা নিজেদের প্রাণকে বিসর্জন নিয়েছেন। অন্যদিকে আমরা দেখি, মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও মার্কিন জনগণ তথা লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং গণমানুষের বিশাল অংশ স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থক ছিল। সে সময় সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা পাকিস্তানে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ রাখতে মার্কিন প্রশাসনকে বাধ্য করেছিল। নাবিক ও সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের মুখেই অস্ত্রবোঝাই জাহাজ বন্দরে অবরোধ করে রাখা হয়েছিল ।
এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, ৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পাকিস্তানের পাকিস্তানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের শহর ও গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা বিমান, ট্যাংক, অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক অস্ত্র/সরঞ্জাম ব্যবহার করেছে। ফরাসি বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মালরো প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করাতে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। অনুপ্রাণিত হন। অনেক লেখক, শিল্পী। এদের প্রভাব ছিল তৎকালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর।
পরাশক্তি কি :
মূলত পরাশক্তি তাদেরকেই বলা হয় যাদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। তৎকালী বিশ্বের স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের উপর পারমাণবিক বোমা প্রয়োগ করেছিল। পরবর্তীতে একে একে অনেক রাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তি অর্জন করে এবং অস্ত্র তৈরি করে।
সাধারণত পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি রাষ্ট্র বা প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রসমূহের একাধিক ব্লক নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর জন্য এবং ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ করে। তবে এ অবস্থা বিশ্বের পরিস্থিতিকে নাজুক ও অস্থির রাখে। এমনকি অন্যান্য রাষ্ট্র পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে উঠলে বিশ্বের মাতকার শ্রেণীর পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলোর মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- বর্তমানে উত্তর কোরিয়া ও ইরানের পারমাণবিক শক্তি আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। আর ইরাকের পরিস্থিতিতো সবার জানা। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে এ অজুহাতে তাদের ওপর আগ্রাসন চালিয়েছে বর্তমান বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি।
১৯৭১ সালে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন আদর্শগত দিক দিয়ে আলাদা হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে সর্বদায় শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা বিরাজ করতো। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মিলে বিশ্বের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ একটি ব্লক এবং পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে পৃথিবীর অপরাপর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ জোট বেঁধেছিল। ফলে এদের একটি যদি কোনো রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতো তাহলে অপর ব্লকটি সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতো। তাছাড়া আন্তর্জাতিক কূটনীতি তো রয়েছেই।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তির ভূমিকা :
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তৎকালীন পরাশক্তির ভূমিকা বিশ্লেষণ করার আগে আমাদের এটা মনে রাখতে হবে, এসব রাষ্ট্রসমূহের জনগণের ইচ্ছাই প্রশাসনের সর্বশেষ ইচ্ছা নয় বরং অনেক সময় প্রশাসন জনমত উপেক্ষা করে নিজেদের স্বার্থ ও রাজনেতিক কৌশল বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এসব সিদ্ধান্তের পিছনে আন্তর্জাতিক কূট চাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মুক্তিযুদ্ধের কিছু আগে সোভিয়েত রাশিয়া চেয়েছিল ভারত-পাকিস্তানকে একটি ব্লক হিসেবে দাঁড় করিয়ে চীনের প্রভাবকে কমিয়ে আনা। কেননা, সে সময়ের আগেই সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে চীনের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। এজন্য ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থামানোর জন্য রাশিয়া মধ্যস্থতা করেছিল। এর মধ্যে ভারত-চীন যুদ্ধের ফলে ভারত তার দুই সীমান্তে (পাকিস্তান-চীন সীমান্ত) রক্ষা করতে গিয়ে প্রতিরক্ষা বায় চারগুণ বাড়িয়ে ফেলে।
ফলে তার উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যায় এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এসব কারণে পূর্ব বাংলার সীমান্তে প্রতিরক্ষা খরচ কমানোর জন্য ভারত এ এলাকার জনগণের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। এজন্য ১৯৬৫ সালে যুদ্ধে ভারত পূর্ব বাংলাকে আক্রমণ করেনি। যদিও এ এলাকা প্রায় অরক্ষিত ছিল। নিজের নিরাপত্তা ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য ভারত সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে।
জেনারেল কাউল তার আত্মকথায় স্বীকার করেছেন, “কোনোরকমের সামরিক হামলা না করে পূর্ব পাকিস্তানের জনমতকে জয় করাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল।”
১৯৭১ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে ভারত সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। প্রথম থেকেই সোভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সক্রিয় সহায়তা দান করেছে। ভারতে সাথে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার আগেও বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি সোভিয়েতের সমর্থন ছিল। একই সাথে এ ঘটনায় অন্যান্য রাষ্ট্রও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অনুকূল মনোভাব দেখায়।
স্বাধীনতাযুদ্ধ কালে ভারতের সাথে সোভিয়েত রাশিয়া মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হয়। পাকিস্তানের সাথে আসন্ন যুদ্ধে জয়লাভের জন্য প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র থেকে শুরু করে সবধরনের অস্ত্র ভারত সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে পেয়েছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে চীনের বন্ধুত্বের উৎসমূল হলো, ভারত ও চীনের যুদ্ধ হওয়াতে তাদের মধ্যে সৃষ্ট শত্রুতা।
অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে চীনের আদর্শগত কারণে যে বন্ধুত্ব সে সময় তা শত্রুতায় পরিণত হয়। ফলে চীনের নিয়ন্ত্রণ যেন বাড়তে না পারে এজন্য ভারত-সোভিয়েত নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি করে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন দান করে দুটি দিক দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া লাভবান হতে চেয়েছে।
প্রথমত এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব আটকানো। আর এটি সম্ভব কেবল এশিয়ার অন্য বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারতকে চীনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী করে গড়ে তুলে।
দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা চলছিল, সে সময় পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন নিয়েছিল এবং সামরিক চুক্তি ছিল পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। এজন্য রাশিয়া চেয়েছিল পাকিস্তানকে ভেঙে দু ভাগ করে পরে পাকিস্তানের মূল অংশের মধ্যে ভাঙনের প্রক্রিয়া দ্রুত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও কূটনৈতিক বিজয় অর্জন করতে।
চীন এই উপমহাদেশে সোভিয়েত রাশিয়ার মনোভাব বুঝতে পেরে ভারতের শত্রু পাকিস্তান, যে রাষ্ট্রটি উপমহাদেশের অপর শক্তিশালী রাষ্ট্র, তার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তারকারী এক বৃহৎ শক্তি। দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতেও তার আধিপত্য ছিল অনুরূপ। সোভিয়েত রাশিয়া এবং চীনের বিপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আধিপত্যের সমর্থনে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছিল।
চীনের সাথে রাশিয়ার বিরোধ বাধার আগে চীনসহ সোভিয়েত রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ পক্ষ নিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক শিবিরের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিয়েছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় ধনতান্ত্রিক দেশসমূহের মিলনে গঠিত ধনতান্ত্রিক শিবিরের। পৃথিবীব্যাপী আধিপত্যের লড়াইয়ে ধনতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিরোধ যখন স্পষ্ট তখন রাশিয়ার ক্রুশ্চেভ প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি ঘোষণা করলে একে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়।
চীন ঘোষণা দেয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং সংশোধনবাদের পথে পা বাড়িয়েছে। যারা সম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে সহযোগিতা করে তাদের পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করার নৈতিক অধিকার নেই । এর বিরোধকে কেন্দ্র করে যারা দুনিয়ার সমাজতান্ত্রিক শিবির চীন ও রাশিয়া-এই দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়।
পরবর্তীতে রাশিয়ার প্রভাব ঠেকানোর জন্য চীনও একই পথে পা বাড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন টেবিল টেনিস কূটনীতির মাধ্যমে একটি সম্পর্ক গড়ে নেয়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আলোচনার বেলায চীন ও সোভিয়েত দ্বন্দ্বের এ প্রকৃতিটি বোঝায় এবং উপলব্ধি করা জরুরি। আয়ুব খান ক্ষমতায় থাকার সময়েই পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার ভিত্তিতে ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতাবান চুক্তি গড়ে তুলেছিলেন। পারস্পরিক প্রয়োজনে একে অপরকে সামরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দেয়। ফলে পাকিস্তান প্রচার চালানো শুরু করে।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের তিন শ্রেণীভুক্ত মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য পাকিস্তান তিন
ধরনের প্রচারণা চালানো শুরু করে।
১. জনগণের যে অংশটি কেবল বৃহত্তর ইসলামী রাষ্ট্র অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মনোভাব পোষণ করতেন, তাদের জন্য পাকিস্তান প্রচার করে পাকিস্তানের পিছনে আরব বিশ্ব, তথা মুসলিম জনগণ রয়েছে। যে কোন মুহূর্তে তারা ইসলামের জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।
২. যারা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধী ছিল তাদের জন্য প্রচার করেছিল- পাকিস্তানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি হয়েছে । অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর চলে আসবে। ৩. যারা রুশ ভারত চক্রের বিরোধী, তাদের উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয়, অতি শীঘ্র পাকিস্তানের বন্ধু চীন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। যদিও বাস্তবে এর কোনোটিই শেষ পর্যন্ত ঘটেনি।
বাংলাদেশের তৎকালীন অবস্থা প্রসঙ্গে আদ্রে মালরো বলেছিলেন, বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী কৌশলবিদরা বলেন, এটি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার সংঘাত মাত্র। তবে মালরো মনে করেন ঘটনা কেবল সেটিই নয়। বরং পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যে ধরনের নিপীড়ন চালিয়েছে তার প্রেক্ষিতেই মুক্তিযুদ্ধ ঘটে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের সুবিধা ও কূটনীতি অনুযায়ী ভূমিকা গ্রহণ করে ।
সে সময় ফরাসি মেজর দ্য গল বলেন, “কোনো পক্ষ নেয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে নেই।”
এক্ষেত্রে জয় প্রকাশ নারায়ণ এর লেখা থেকে আমরা উদ্ধৃতি দিতে পারি, “বাংলাদেশের সমস্যাবলী নিয়ে বিশ্বের দুটি রাষ্ট্র আমেরিকা ও ফ্রান্স অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিল যে পাকিস্তানকে আর অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানে আরও ছয়-সাত জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে। ফ্রান্স সরাসরি পাকিস্তানে অস্ত্রশস্ত্র না পাঠালেও, সেখানে খোলা বাজারে পাকিস্তান সরকারের কাছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করছে।”
১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সোভিয়েতের সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি নিকোলাই পদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে যে বার্তা পাঠান তাতে উল্লেখ করেন বলপ্রয়োগ না করে রাজনৈতিকভাবে এই পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান করতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো সপ্তম নৌবহর নিয়ে নানা মত আছে, ওরান স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকাটি মনে কনে, বঙ্গোপসাগরে পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন বিদেশী জাহাজ পাঠানো ছিল পুরাতন কায়না ও অপরিপক্ক চিন্তার ফসল ।” অর্থাৎ খোদ মার্কিনি মিডিয়ার একাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরোধিতা করে ।
তাই এ কথা অনস্বীকার্য যে বিশ্বের বিভিন্ন পরাশক্তির অনেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের জনমত উপেক্ষা করে যেমন বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে তেমনি অনেকে পক্ষালম্বনও করেছে।
উপসংহার :
মরিস বলেন, ‘বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়াতে পরাশক্তির ভারসাম্যতার কোন পরিবর্তন হয়নি। তাছাড়া কৌশলগতভাবে মার্কিন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এটি তেমন কোনো পরাজয় নয়।” কিন্তু নিউইয়র্ক বলে, ‘পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পরাজয় একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও একটি পরাজয়’ অর্থাৎ আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারি যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল পাকিস্তানের দুটি অংশের বিরোধ ও বৈষম্যের ফসল নয়, এর সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ওতোপ্রতভাবে জড়িত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য যেমন অস্ত্র ও সৈন্য সরবরাহ করেছে তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাই বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তির ভূমিকা ছিল।
আরও দেখুনঃ