সংরক্ষিত নারী আসন ও বাংলাদেশ :
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণ কর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
মানব জাতির অর্ধেক অংশই নারী। আর এ নারীকে বাদ দিয়ে যে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তা বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে। জাতীয় জীবনে নারীর অংশগ্রহণের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন একান্ত প্রয়োজন। আর নারীর ক্ষমতায়ন হলো নারী-পুরুষের মধ্যকার অসমতা ও বৈষম্য দূর করে নারীকে সমদক্ষতায় প্রতিষ্ঠিত করা। এর জন্য দেশের সংবিধান সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আর এজন্য রাষ্ট্রকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে। সমাজে নারীর ভূমিকা ও গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
Table of Contents
সংরক্ষিত নারী আসন ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে নারীর সার্বিক অংশগ্রহণের জন্য সংবিধানের ৬৫ (৩) ধারায় নারীর জন্য জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। জাতীয় সংসদে বিভিন্ন সময়ে নারী আসন সংরক্ষিত ছিল। ২০০৪ সালে সর্বশেষ সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাস হওয়ার মাধ্যমে বর্তমান জাতীয় সংসদে নারী আসনের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪৫-এ উন্নীত করা হয়েছে ।
সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ও সংবিধান
বাংলাদেশের সংবিধানে সাধারণ ৩০০ এবং সংরক্ষিত ৩০টি আসনে নারী প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করা এবং অংশগ্রহণের বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন ও নীতি রয়েছে। সংবিধানের ৬৫(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদেরকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।’
সংবিধানের ৬৫(৩) ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধান (দশম সংশোধন) আইন, ১৯৯০ প্রবর্তন কালে বিদ্যমান সংসদের অব্যবহিত পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে শুরু করিয়া দশ বৎসর কাল অতিবাহিত হইবার অব্যবহিত পরবর্তী কালে সংসদ ভাঙ্গিয়া না যাওয়া পর্যন্ত ৩০টি আসন কেবল মহিলা সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকিবে এবং তাঁহারা আইনানুযায়ী।
পূর্বোক্ত সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হইবেন। তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার কোন কিছুই এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন কোনো আসনে কোনো মহিলার নির্বাচন বিঘ্নিত করিবে না।
সংরক্ষিত নারী আসন ও জাতীয় প্রেক্ষিত
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে নারীদের সরাসরি নির্বাচন ও সংরক্ষিত নারী আসনের সূত্রপাত ঘটে। বিভিন্ন সময়ে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে। পাকিস্তান আমলে ৭টি নারী আসন সংরক্ষিত ছিল। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত ছিল। এরপর থেকে সপ্তম সংসদ পর্যন্ত নারী আসন সংরক্ষিত ছিল ৩০টি।
সপ্তম সংসদ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে অষ্টম সংসদের প্রথম দিকে (২০০১-২০০৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত) সংরক্ষিত নারী আসন শূন্য ছিল। ২০০৪ সালের ১৬ মে জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাস হওয়ার মাধ্যমে সংরক্ষিত নারী আসন সংখ্যা ৩০ থেকে ৪৫ এ উন্নীত করা হয়।
সংরক্ষিত নারী আসন ও সুশীল সমাজের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সর্বশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে নারী আসন ৪৫টিতে উন্নীত করা হলেও বিভিন্ন মহল তাদের মতামত প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ তাদের মতামত প্রকাশ করে বলে, সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬৪টি করা এবং সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারী-পুরুষ সব ভোটার কর্তৃক নির্বাচিত করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের সময় নারী আসন ও সাধারণ আসনের প্রার্থী নির্বাচনের পদ্ধতি প্রচলনেরও দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
এছাড়া নারীপক্ষ তাদের মতামতে ৬৪টি জেলাকে ৬৪টি আসনে বিভক্ত করা, বাধ্যতামূলক মহিলা প্রার্থ মনোনয়ন, বিভিন্ন দলের মহিলা প্রার্থীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ভোট পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং জাতীয় নির্বাচনকালে দুটি ব্যালট বাক্স ও ভোটারগণের একই সাথে দুটি ভোট প্রদান ইত্যাদি দাবি তুলে ধরে।
উইমেন ফর উইমেন সংরক্ষিত আসন দ্বিগুণ করতে, রাজনৈতিক দলগুলোতে মহিলা প্রার্থীর মনোনয়ন বৃদ্ধি এবং মহিলা ভোটারদের ভোট দ্বারা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবি জানায়। এছাড়া সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ১০০টি করে জাতীয় আসন ৪০০টি করার বিষয়ে মতামত দিয়েছে। তবে নারী প্রার্থীরা জনগণের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নির্বাচনের দাবি জানায়।
নারী আসনে অংশগ্রহণের চিত্র
স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনে মোট ১৬৫ জন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। দেশে সংসদ নির্বাচন হয়েছে আট বার। এর মধ্যে ছয়টিতে সংসদে সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্য ছিলেন।
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনে নারীদের অংশগ্রহণ
নির্বাচনের কাল | দলের নাম | নির্বাচন পদ্ধতি | আসন সংখ্যা |
১৯৭৩ | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ | নির্বাচিত ৩০০ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত | ১৫ |
১৯৭৮ | বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল | ” | ৩০ |
১৯৮৬ | জাতীয় পার্টি | ” | ৩০ |
১৯৯১ | বিএনপি ও জামায়াত | ” | ২৮+২ |
১৯৯৬ | বিএনপি | ” | ৩০ |
১৯৯৬ | আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি | ” | ২৭+৩ |
তবে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সংসদে কোনো সংরক্ষিত আসন ছিল না। পরে ২০০৪ সালে চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫টিতে বৃদ্ধি করা হয়।
নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের সুবিধা ও অসুবিধা:
বাংলাদেশের সংবিধানে নারীদের জন্য সংসদে ৪৫টি আসন সংরক্ষণের যে বিধান রাখা হয়েছে তা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের সরাসরি নির্বাচনের
বিপক্ষে। ফলে বিদ্যমান আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নারী আপন সংরক্ষণের পদ্ধতিটি নিম্নরূপ হলে জাতীয় জীবনে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেত।
১. ৬৪টি জেলার প্রতিটিতে একটি করে নারী আসন সংরক্ষিত থাকবে যেগুলোতে শুধু নারীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ।
২. প্রতিটি রাজনৈতিক দল থেকে ২৫% নারী প্রার্থী মনোনয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৩. সংসদে মোট আসনের ২০% নারীদের সরাসরি নির্বাচনের জন্য সংরক্ষিত রাখা।
সংরক্ষিত নারী আসনের সুবিধা
১. নারীর রাজনৈতিক মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্তকরণ।
২. সংসদ অলংকরণ।
৩. সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে এবং সরকার গঠনে সহায়তা।
৪. নির্বাচনী ব্যয় সংকোচন ।
৫ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন ।
সংরক্ষিত নারী আসনের অসুবিধা
১. জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত না হওয়ার ফলে জনসমর্থন থাকে না।
২. সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য এবং সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি ।
৩. নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নে অন্তরায় সৃষ্টি হয় ।
৪. রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ায় যোগ্য লোক নির্বাচিত হয় না।
৫. সামাজিক দায়বদ্ধতা তুলনামূলকভাবে কম।
৬. সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট আসনে একাধিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ায় এবং মহিলাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি না থাকায় উভয়ের মাঝে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি
বর্তমান সমঅধিকার যুগে সংসদে নারী আসন সংরক্ষণকে নারী স্বাধীনতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্তরায় মনে করা হয়। বাংলাদেশের মতো একটি তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র, অধিক জনবহুল এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশের জন্য জাতীয় জীবনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ একান্ত আবশ্যক।
নারীর রাজনৈতিক মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্তকরণ
বাংলাদেশের সংবিধানে মোট আসন সংখ্যা (সংরক্ষিত আসন ছাড়া) ৩০০টি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে এই ৩০০টি আসনের সরাসরি নির্বাচনে মাত্র ২-৩% আসনে নারীদের নির্বাচিত করা হয়। জাতির অর্ধেক অংশ নারী বিধায় জাতীয় জীবনের উন্নয়নে এবং নারীর ক্ষমতায়ন সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য জাতীয় সংসদে নারীর অংশগ্রহণ একান্ত আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রেক্ষিতে ১৯৮৯ সালে দশম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নারীদের আসন ৩০টি করা হয়।
কিন্তু ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে অর্থাৎ সপ্তম সংসদ চলাচালীন তা বলবৎ ছিল। অষ্টম জাতীয় সংসদের শুরু থেকেই সংরক্ষিত নারী আসন বিহীন অবস্থায় সংসদ চলে আসছে। এতে দেশের নারী সমাজের মাঝে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
তাই সরকার জ জীবনে নারীদের সর্বাঙ্গীন অংশগ্রহণের জন্য ১৬ মে ২০০৪ চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে নারী আসন বাড়ির ৩০ থেকে ৪৫ করে। যদিও ৪৫টি আসন যথার্থ নয়। তথাপিও দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়নে চতুর্দশ সংশোধনী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া চতুর্দশ সংশোধনীর পূর্বে যেখানে ২৪ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করারই সুযোগ ছিল না সেখানে চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সুযোগ সৃষ্টির পাশাপতি আসন সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে । সে সাথে রাখা হয়েছে আনুপাতিক হারে সদস্যপদ পাওয়ার ব্যবস্থা। বিষয়টিতে অনেকেই নারীকে রাজনৈতিক মূলস্রোতধারায় সম্পৃক্তকরণে তাৎপর্য পূর্ণ বলে মনে করে। মূলত নারীর ক্ষমতায়নের পথ এ বিলের মাধ্যমে অনেকটা সুগম হবে।
সাম্প্রতিক নারী আসনে নির্বাচন-২০০৫
৬ সেপ্টেম্বর ২০০৫ জাতীয় সংসদে বহুল আলোচিত ৪৫টি সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯ জুলাই ২০০৫ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ন আসনের নির্বাচন নিয়ে হাইকোর্টের রায়কে বহাল রাখেন। ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সকল বাধা দুর হয়।
জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর মধ্যে আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন করে সঙ্গে সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনকে হাইকোর্ট বিভাগ বৈধ এবং সংবিধান সম্মত বলে যে হয় দিয়েছিলেন তা বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্ট। এ রায়ের ফলে ১৯ জুলাই ২০০৫ থেকে পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে নারী আসনের নির্বাচন সম্পন্ন করার বিধান বহাল হয়।
নির্বাচন সংক্রান্ত মামলা ও আদালতের রায়
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৪৫টি আসন সংরক্ষণ করে ১৬ মে ২০০৪ সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী বিল পাস হয়। বিলের দফা ৩ অনুযায়ী নবম সংসদের প্রথম অধিবেশন থেকে আগামী দশ বছর পর্যন্ত সংসদে ৪৫টি নারী আসন সংরক্ষণ করা হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে তারা একক হস্তান্তরযোগ্য ভোট নির্বাচিত হবেন। এ ছাড়া সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী বিলের এক দফা অনুযায়ী বর্তমান অষ্টম সংসদের মেয়াদ পর্যন্ত ৪৫টি নারী আসন সংরক্ষণ করা হবে এবং তারাও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। এ বিধানের আলোকে পরবর্তী 80 দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করেন।
২৯ নভেম্বর ২০০৪ নারী আসনে নির্বাচন আইন পাস হয় এবং ৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এ আইনে স্বাক্ষর করেন। পরে ৪৫ দিনের জায়গায় ৯০ দিন করে এ আইনে সংশোধনী এনে রাষ্ট্রপতি ২১ ডিসেম্বর অধ্যাদেশ জারি করেন। এ অধ্যাদেশটি ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ জাতীয় সংসদে ‘সংরক্ষিত মহিলা আসন নির্বাচন সংশোধন আইন, ২০০৫’ নামে পাস হয়। ১ মার্চ রাষ্ট্রপতি আইনটিতে সম্মতিদানের পর অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
সংশোধিত আইন অনুযায়ী ৭ মার্চ ২০০৫ এর মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু রিট মামলার কারণে এতদিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এ নির্বাচন আইন চ্যালেঞ্জ করে ১৩টি নারী ও মানবাধিকার সংস্থার নেত্রীদের হাইকোর্টে দায়ের করা ৩টি পৃথক রিট ৩০ মে ২০০৫ হাইকোর্ট খারিজ করে দেন। সর্বশেষ ১৯ জুলাই ২০০৫ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ লিভ টু আপিল খারিজ করে দেয়ায় হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকে।
কোন দল কতটি আসন পায় :
৫ জানুয়ারি ২০০৫ নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদের নারী আসলের নির্বাচন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সংসদ সদস্যদের দল বা জোটওয়ারী তালিকা প্রকাশ করে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নোটিশ বোর্ডে মোট ৯টি জোট বা দলের ভোটারদের তালিকা টানিয়ে দেয়া হয়।
অতঃপর ৪ সেপ্টেম্বর ২০০৫ সংরক্ষিত নারী আসনের ৩৬ জন মহিলা সদস্যকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। ৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৫ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে নব নির্বাচিত ৩৬ নারী সংসদ সদস্যদের অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। তবে আওয়ামী লীগ তাদের জন্য বরাদ্দ ৯টি আসনে কোনো প্রার্থী না দেয়ায় উক্ত ৯টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
দল | বর্তমান সংসদ সদস্য | নারী আসন পায় | আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দেয়ায় অন্য দলগুলো পেয়েছে |
বিএনপি (স্বতন্ত্র প্রার্থী এস. এম শাহীন্সহ) | ১৯৮ |
৩০ |
৩৬ |
আওয়ামী লীগ | ৫৯ | ৯ | – |
জামায়াতে ইসলামী | ১৭ | ৩ | ৪ |
জাতীয় পার্টি (এরশাদ) | ১৪ | ২ | ৩ |
বিজেপি ও ইসলামী ঐক্যজো | ৫ | ১ | ২ |
২৯৩ | ৪৫ | ৪৫ |
বাকি ৭ সদস্যের দল বা জোট নারী আসন পায়নি
নির্বাচন কমিশন তালিকা অনুযায়ী টাঙ্গাইল ৮ আসনের সংসদ সদস্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মাহী বি চৌধুরী ও শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কে এম হেমায়েতুল্লাহ আওরঙ্গকে নিয়ে গঠিত হয় একটি জোট কিন্তু তারা প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ায় ঐ জোট কোনো আসন পায়নি। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির একমাত্র সদস্য আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নিজেই।
ফলে ঐ জোটও কোনো আসন পায়নি। মুফতি ফজলুল হক আমিনী বিজেপির জোটে যোগ দেয়ায় ইসলামী ঐক্যজোটে (আজিজুল হক) সদস্য রয়েছে দুজন। এছাড়া নির্দলীয় জোট হয়েছে একমাত্র স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মানিকগঞ্জ ২ আসনের সামসুদ্দিন আহম্মেদকে নিয়ে। ফলে শেষের দুটি জোট বা দলও কোনো আসন পায়নি।
বাংলাদেশে নারী উন্নয়নে বাধা
স্বাধীনতার ৩৫ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের নারীরা উন্নত দেশের নারীদের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে। নারীর অগ্রগতির এ বাধার পিছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিদ্যমান। বাংলাদেশে নারী উন্নয়নে প্রধান অন্তরায়সমূহ নিম্নরূপ
সামাজিক অবস্থান
- সমাজ বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে তেমন সচেতন নয়।
- সরকারি বিভিন্ন আইন ও নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও নারীদের প্রতি অবিচার ও অবহেলা অব্যাহত।
- নারীদের নিজেদের সম্পর্কে কোনো নিজস্ব ইমেজ নেই।
- পরিবারে শিক্ষার চেয়ে মেয়েদের নম্রতা শিক্ষায় বেশি জোর দেয়া হয় ।
- অত্যাধিক দারিদ্র্য ।
- সামাজিক নিরাপত্তার অভাব।
- সামাজিক কুসংস্কার।
- কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সীমাবদ্ধতা।
- যৌতুক প্রথার ব্যাপকতা।
- নারীর প্রতি অযৌক্তিক সামাজিক আচরণ।
- প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি বৈষম্য।
আইনগত দিক
- নারীরা তাদের আইনগত অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়।
- সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে নারীদের উন্নয়নের নির্দেশ রয়েছে কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ কম।
- আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অনেক ব্যবধান রয়েছে।
- আইন বাস্তবায়নের সামাজিক আন্দোলনে সহযোগিতার অভাব।
- শিক্ষার অনগ্রসরতাহেতু নিজেদের করণীয় সম্পর্কে অক্ষমতা।
ধর্মীয় দিক
- মোয়া-মৌলভীদের দৌরাত্ম্য।
- ফতোয়া।
- কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন ।
- বিভিন্ন ধর্মীয় বিধানের ভুল ব্যাখ্যা।
- ইসলামে নারীর অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা।
সাম্প্রতিক পর্যালোচনা
একটি দেশের রাজনৈতিক তথা আর্থসামাজিক সংস্কৃতির ওপর সে দেশের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ভর করে। অর্থাৎ নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিফলিত হয় সে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কাঠামো এবং অবকাঠামোর ওপর। অন্যদিকে দেশ ও সমাজের উন্নয়ন প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনা, জেন্ডার বৈষম্য প্রভৃতি দূরীকরণের জন্য নারীর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই ৷
তাই সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি, সংরক্ষিত আসনে নারীদের ক্ষমতাহীনতা, কম গুরুত্ব, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর প্রাপ্তিক অবস্থান ইত্যাদি বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচন করা হচ্ছে। নারীর জন্য সাধারণ আসনে কোটা নির্ধারণ বা সংরক্ষণে কোনো প্রক্রিয়া চালু না রেখে অতিরিক্ত ৩০টি আসন বরাদ্দ এবং এ ধরনের পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নারী আসন সংরক্ষণের নজির বিশ্বে আর কোথাও নেই।
এ ধরনের নারী কোটা সংরক্ষণ প্রকৃতপক্ষে অবমাননাকর বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সংরক্ষিত নারী আসনকে মর্যাদার উত্তীর্ণ এবং এর পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা দরকার। বিভিন্ন সংগঠন, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ এ বিষয়ে তাদের সুচিন্তিত সুপারিশ প্রদান করেছেন। বিভিন্ন আলোচনা সভায় মতবিনিময় দরকার।
উপসংহার
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪৮ ভাগ নারী, জাতীয় আয়ে নারীর অবদান ৩০ ভাগ। অথচ মোট সম্পদের এক ভাগের মালিক নারী, মোট আয়ের দশ ভাগ পায় নারী। বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, নারীদের কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি থাকায় প্রতিদিন ১১ বিলিয়ন ডলার বিশ্ব অর্থনীতি থেকে হারিয়ে যায় অর্থাৎ হিসাব করা হয় না।
এ বৈষম্য দূর করা না গেলে একদিন পুরো উন্নয়ন কাঠামো ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে নারীদের অধিক সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব বাধা রয়েছে তা দূর করতে হবে। অন্যথায় দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সুদূর পরাহত।
আরও দেখুনঃ