মুক্তিযুদ্ধে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ: মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণের সহায়তাসহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার পাশাপাশি বিশ্বজনমত তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে বিশ্বজনমত তৈরির জন্য ভারতের পাশে একটি পরাশক্তির প্রয়োজন ছিল। কারণ চীন ও আমেরিকা এই দুই পরাশক্তি ভারতের অনুকূলে ছিল না।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টিগুলো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরোপুরি এবং সরাসরি সমর্থন প্রদানে তখনও দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আর একারণেই বাংলাদেশের প্রথম সরকার বা বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার।

মুক্তিযুদ্ধে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ
তাই ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে সর্বদলীয় ঐক্য স্থাপনের বিষয়টি বিশদভাবে আলোচিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, ৮ সেপ্টম্বর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মন্ত্রিপরিষদ দেশে বিদেশে জনপ্রিয় বামপন্থি নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি মস্কোপন্থির নেতা যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য কমরেড মণি সিংহ, ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ও পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির প্রধান নেতা এবং ভারতে যিনি খুবই গ্রহণযোগ্য মনোরঞ্জন ধর-এর সাথে গোপন স্থানে জরুরি বৈঠকে মিলিত হবেন।
বৈঠক উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজ হাতে একটি আমন্ত্রণপত্র লিখে প্রত্যেকের কাছে পাঠান। পত্রের বর্ণনা ছিল এরকম:
“আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পটভূমিতে সমস্যাবলী আলোচনা করার উদ্দেশ্যে আমার অফিসে আগামী ৮ই সেপ্টেম্বর বুধবার পূর্বাহ্ণ ১০টায় (বাংলাদেশ সময়) এক বিশেষ সভা আহ্বান করেছি। আপনার উপস্থিতি এবং মূল্যবান পরামর্শ একান্তভাবে কামনা করছি।”
নিজ হাতে বাংলাদেশ সরকারের প্যাডে আমন্ত্রণপত্র লেখা ছিল তারিখ ও সালসহ (৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১)। ৮ সেপ্টেম্বর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে দলের নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ৮ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। দলগুলো হলো:
সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের দলগুলো:
১. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
২. ন্যাপ (ভাসানী)
৩. ন্যাপ (মোজাফফর)
৪. কমিউনিস্ট পার্টি
৫. বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস।
মুক্তিযুদ্ধে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত নেতৃবৃন্দ হলেন :
১. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ, ভাসানী)
২. কমরেড মণি সিংহ ( বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি)
৩. অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ (ন্যাপ, মোজাফফর)
8. মনোরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস)
৫. তাজউদ্দীন আহমদ (বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী)
৬. খন্দকার মোশতাক আহমেদ (বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী)
৭. আওয়ামী লীগের আরো দুজন সদস্য
উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি মনোনীত হন মওলনা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কমিটির সভা আহ্বান ও পরিচালনা করবেন।
উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভা ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর দুইদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় মুজিব নগরে। সভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, মনোরঞ্জন ধর, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, মনসুর আলী (বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী), এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান (বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), এম.এ. সামাদ (রাজনৈতিক উপদেষ্টা)।
বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দেশবাসীর দৃঢ় মনোবল নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার বিষয়ে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ আহ্বান জানান। এছাড়াও সভায় বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। বৈঠকে সাত দফা প্রস্তাব গ্রহণ করে বলা হয়:
বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোনো প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না। উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের বিষয়ে সেদিন বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশের ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের বিনাশে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করে সব সম্প্রদায়ের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা-সংগ্রামে যোগদানের বিষয়টি কমিটি অবশ্যই নিশ্চিত করবে।
কমিটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আস্থাবান মুক্তিকামী জনসাধারণের মধ্যে একতার প্রতিফলন ঘটানো নিশ্চিত করবে। সভায় বাংলাদেশ সরকারকে তাৎক্ষণিকভাবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ভারতসহ বিশ্বের সব দেশের প্রতি আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ ছাড়া সভায় যুদ্ধ উপকরণাদি প্রদান করে মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশ সরকারকে সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান করতে তাদের প্রতি আকুল আবেদনও জানানো হয়।

সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ও উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভার সিদ্ধান্তসমূহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন মিশন অফিস থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারের জন্য সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তি আকারে পাঠানো হলে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত বাড়তে থাকে। পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের প্রথম সরকার ও জনগণের দুঃখ কষ্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশে এগিয়ে আসে।
আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করায় বিশ্বব্যাপী মুজিবনগর সরকার একটিই বার্তা দিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি বাঙালির সর্বজনীন; কোনো দল বা গোষ্ঠীর একক কোনো বিষয় নয়। বাঙালি তার স্বাধিকার আদায়ের প্রশ্নে অবিচল। যে কারণে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য ঘটনা।
বিশ্বজনমত ও কূটনৈতিক সমর্থন তারপর থেকে জোড়ালো হয়। বিশেষ করে শক্তিধর পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের অকুণ্ঠ সমর্থন মিলে এবং সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চীন ভারতের প্রতি প্রথম দিকে বৈরী ভাবাপন্ন থাকলেও, বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে চীন সরকার অনেকটা নম্র অবস্থান গ্রহণ করে। ভারত সরকার তখন বাংলাদেশের জন্যে বিশ্বজনমত ও কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ে আরও তৎপর হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: